৮ আগস্ট, ২০১৩

আমরা বাংলাদেশে আসলে কি বারে জুমার নামাজ পড়ি?

আমরা যেদিন জুমার নামাজ পড়ি আরবের পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোতে সেদিন চাদের হিসেবে শুক্রবার নয় বরং বৃহস্পতিবার।
সূর্যের হিসাবে ঠিক কখন বা কোথায় দিন আরম্ভ হয় বলা কঠিন। মানুষে সুবিধার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম তীর হতে দিন গণনা করা হয়। কিন্তু চাঁদের হিসাবে একটা দিন বা তারিখ কখন বা কোথায় আরম্ভ হবে তা সুস্পষ্ট। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিশ্লেষণে দেখা যায় যে চাঁদের তিথি আরব উপত্যকায়ই প্রথম দৃশ্বমান হয়। অর্থাৎ চাঁদের হিসাবে তারিখ বা বার আরম্ভ হয় আরব উপত্যকা থেকে।
যেমন: এই বছর(২০১৩) ১লা শাওয়াল আরবেই প্রথম চাদ দেখা গেছে এবং এই চাদের সাথে যে দিনটি আরম্ভ হয়েছে তা বৃহস্পতিবার। এরপর পৃথিবীর আবর্তনের কারনে এর ২১ ঘন্টা পরে বাংলাদেশেও চাদ দেখা যাবে, ঠিক তখন থেকেই এখানে হিজরি তারিখ অনুসারে ১লা শাওয়াল গননা করা হবে। এখন যেহেতু আরবের ২১ ঘন্টা পরে বাংলাদেশে কোন হিজরি তারিখ আরম্ভ হয়, সেহেতু হিজরি বারও কি বাংলাদেশে আরবের ২১ ঘন্টা পরে আরম্ভ হওয়া উচিৎ না? বাস্তবে আমরা আরবের ২১ ঘন্টা পরে(-২১) বার আরম্ভ না করে আরবের ৩ ঘন্টা আগে(+৩) বার গননা আরম্ভ। ফলে আমাদের সময় =৩-(-২১)=২৪ ঘন্টা এগিয়ে যাচ্ছে। আমারা বৃহস্পতিবারেই শুক্রবার মনে করে জুমার নামাজ পড়ছি।

সূর্যের হিসাবে জাপান থেকে দিন, তারিখ বা বার গণনা আরম্ভ করা হয়। আরবের পূর্বে জাপান পর্যন্ত দেশগুলোতে সময় আরব থেকে এগিয়ে(+) গণনা করা হয়, বাস্তবে ইসলামিক তারিখ এমনকি বার ঠিক রাখতেও আরবের পূর্বে জাপান পর্যন্ত দেশগুলোতে সময় আরব থেকে পিছিয়ে(-) গণনা করতে হবে। যে দেশগুলোকে আরবের পূর্বে ধরা হয় সেগুলো আসলে আরবের দূর পশ্চিমের দেশ।

সূর্যের হিসাবে বাংলাদেশ, আরব থেকে ৩ ঘণ্টা এগিয়ে মালয়েশিয়া ৫ ঘণ্টা এগিয়ে আর আমেরিকায় ৯ ঘণ্টা পরে দিন, তারিখ বা বার আরম্ভ হয়। আর চাঁদের হিসাবে আমেরিকায় আরব থেকে ৯ ঘণ্টা পরে, মালেশিয়ায় ১৯ ঘণ্টা আর বাংলাদেশে ২১ ঘণ্টা পরে দিন, তারিখ বা বার আরম্ভ হ্য় (২/১ ঘণ্টা কমবেশি হতে পারে)। আমরা বাংলাদেশ আরব থেকে ৩ ঘণ্টা আগে মালয়েশিয়া ৫ ঘণ্টা আগে বার (যেমনঃ শুক্রবার) আরম্ভ করি। কিন্তু চাঁদের হিসাবে মালয়েশিয়া বা বাংলাদেশে শুক্রবার আরম্ভ হতে তখনও যথাক্রমে ১৯ ও ২১ ঘণ্টা বাকি।

জাপান থেকে সময়ের সূচনা ধরায় আমেরিকায় যখন শুক্রবার তখন বাংলাদেশে শনিবার ছুটি, আর আরব থেকে দিনের সূচনা ধরা হলে বাংলাদেশে শুক্রবার দুপুর ১২টার সময় আমেরিকায় শনিবারের ছুটি আরম্ভ হবে।

অনেক মুসলমানই সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ করার দাবি করেন। আনেকেই চাঁদ দেখা না গেলেও আরবের সাথে মিল রেখে প্রচলিত একই দিনে ঈদ উদযাপন করে থাকেন। শুধু তাই নয়, মালয়েশিয়া সহ দূর প্রাচ্যের কয়েকটি দেশেও চাঁদ দেখা ছাড়াই আরবের সাথে মিল রেখে ঈদ উদযাপন করা হয়। অথচ আরব থেকে সময় গণনা করা হলে এমনিতেই সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ পালিত হবে।

৩১ জুলাই, ২০১৩

মুসলমান জাতির পিতা কে? বেহেস্ত কি একা মুসলমানদের জন্য?

অনেকেই মুসলমান জাতির পিতা কে তা নিয়ে প্রশ্ন করেন তাদের জন্য:
(সূরা হজ্জ ৭৮) : - তোমরা আল্লাহর জন্যে শ্রম স্বীকার কর যেভাবে শ্রম স্বীকার করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে পছন্দ করেছেন এবং ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখেননি। তোমরা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের ধর্মে কায়েম থাক। তিনিই তোমাদের নাম মুসলমান রেখেছেন পূর্বেও এবং এই কোরআনেও, যাতে রসূল তোমাদের জন্যে সাক্ষ্যদাতা এবং তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলির জন্যে। সুতরাং তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে শক্তভাবে ধারণ কর। তিনিই তোমাদের মালিক। অতএব তিনি কত উত্তম মালিক এবং কত উত্তম সাহায্যকারী।
وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ ۚ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ ۚ مِّلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ ۚ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِن قَبْلُ وَفِي هَٰذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ ۚ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَاعْتَصِمُوا بِاللَّهِ هُوَ مَوْلَاكُمْ ۖ فَنِعْمَ الْمَوْلَىٰ وَنِعْمَ النَّصِيرُ [٢٢:٧٨] (সেজদা)

বেহেস্ত কি একা মুসলমানদের জন্য?

কোন কাজ করার ৩ টি কারন থাকতে পারে।
১- নিজের আনন্দের জন্য,
২- অবস্থার প্রেক্ষিতে,
৩- কোন প্রভুর সন্তষ্টির জন্য।
কাজটা ভাল কিছু হলে
- নিজের আনন্দের জন্য করে থাকলে আনন্দটাই আপনার কাজের পুরষ্কার, পরকালে প্রতিদান আশা করার কোন কারন নাই।
যেমনঃ কোন দুর্যোগের খবর শুনে নিজের মনের সান্তনা দেয়ার জন্য সাহায্য পাঠালেন।
- অবস্থার প্রেক্ষিতে করে থাকলেও পরকালে প্রতিদান আশা করতে পারেন না। তারপরও প্রভু পুরস্কৃত করতেই পারেন।
যেমনঃ কোন দুর্যোগের খবর শুনলেন তারপর অফিস থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হল সবার ১ দিনের বেতন দুর্গতদের দেয়া হবে।
- কোন প্রভুর সন্তষ্টির জন্য করে থাকলে প্রতিদান আশা করতে পারেন। এখন দেখতে হবে আপনি কোন প্রভুর সন্তষ্টির জন্য কাজ টি করেছেন।
১। আপনি দুর্যোগের খবর শুনে মানুষ প্রভু যেমন প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে ১ দিনের বেতন দুর্গতদের দিয়ে স্রস্টার সন্তষ্টি আশা করতে পারেন না। বরং স্রস্টাকে খুশি করতে ১ দিনের বেতন দুর্গতদের দিলে একই সাথে প্রধানমন্ত্রীও সন্তষ্ট হতে পারে।
২। ঈশ্বর প্রভুর সন্তষ্টির জন্য করে থাকলেও প্রশ্ন থাকবে যে আপনি প্রকৃত ঈশ্বরের জন্য করেছেন কি না।
যেমনঃ আপনি “ক” এর রাজ্যে বাস করেন আর বলেন “খ” এর জন্য কাজ করেন। তাহলে আশা করা যায় যে আচিরেই “ক” আপনার খোঁজে পেয়াদা পাঠাবে।

স্রষ্টাকে খুশি করতে কোন খারাপ কাজ করলে?
আপনাকে বুঝতে হবে যে খারাপ কাজের ফলে স্রষ্টার-ই কোন বান্দার ক্ষতি হচ্ছে, ফেলে আপনি যে জন্যই করেন না কেন স্রষ্টার খুশি হওয়ার কোন কারন নাই।
যেমনঃ আপনার কোন ভাইকে আপনার বাবা অপছন্দ করেন, তাই বলে আপনি ঐ ভাইয়ের কোন ক্ষতি করলে আপনার বাবা আপনার উপর সন্তষ্ট তো হবেন ই না উল্টো আপনার উপরও রাগ করবেন।

মুসলিম শব্দের অর্থ আত্নসর্মপনকারী, এটি সালাম অর্থাৎ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা থেকে এসেছে। কোরআনে বলা হয়েছে : -
সুরা-বাকারা আয়াত ১৭৭ঃ لَّيْسَ الْبِرَّ أَن تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا ۖ وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ ۗ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার।
সুরা-বাকারা আয়াত ৬২ঃ إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالنَّصَارَىٰ وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ [٢:٦٢]
নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী, নাসারা ও সাবেঈন, (তাদের মধ্য থেকে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি এবং সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনই ভয়-ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।

মুহাম্মদ ইবনুন মুসান্না (র)…আনাস ইবনে মালিক (রাঃ)থেকে বর্নিত, নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ তিনটি গুণ যার মধ্য থাকে সে ঈমানের স্বাদ পায়।
১.আল্লাহ ও তার রাসূল তার কাছে অন্য সব কিছু হতে প্রিয় হওয়া।
২. কাউকে খালিস আল্লাহর জন্যই মুহব্বত করা।
৩. কূফরীতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপছন্দ করা। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ১৫ ঈমান অধ্যায়।)

আমরা কি আসলেই প্রকৃত মুসলিম হতে পেরেছি? না-কি জুম্মাবারে মসজিদে হাজিরা আর কুরবানীর গরুর মাংস খাওয়ার দাবীদার মুসলিম?

২৫ এপ্রিল, ২০১৩

গ্রার্মেন্টস মালিকরা কি বাংলাদেশের নব্য নীলকর? গ্রার্মেন্টস শ্রমিকদেরও মানুষের মর্যাদা দিন।


বাংলার ইতিহাসে নীল বিদ্রোহের সময় নীল চাষীর ক্ষতি হতো ৯ টাকা ৬ আনা। আর নীলকরের লাভ হতো ৩৫ টাকা! নীলকররা নীলচাষীদের মেয়ে/বৌ-কে ধরে নিয়ে যেতো। কেউ কেউ জীবিত ফিরতো, নাহলে পুরো পরিবারকে খুন করে মৃত্যুকূপে ফেলে দেওয়া হত। বর্তমানে গ্রার্মেন্টস শ্রমিকদেরও প্রায় একই অবস্থা।

গ্রার্মেন্টস ব্যবসা থেকে আসলে কত লাভ হয়, কত টাকা গ্রার্মেন্টস মালিকরা দেশে আনেন আর কত দেশের বাইরেই জমা/পাচার করেন তা একমাত্র তারাই বলতে পারবেন। তাদের কাছে ১ জন গ্রার্মেন্টস শ্রমিকের জীবনের দাম টবের ১টা ফুলগাছের চেয়ে কোন ভাবেই বাশি নয়। গত কয়েক বছরে দেশে অনেক গুলো গ্রার্মেন্টস কারখানা ধসে পরেছে বা আগুন লেগে পুড়ে গেছে। যেখানে দেখা গেছে দূর্ঘটনার সময় বা পরে শ্রমিকদের ভেতরে রেখে কারখানার গেট তালা দেয়া ছিলো। এ ব্যাপারে বার-বার শ্রমিক আন্দোলনের পরও কোন সুরাহা হয় নাই। সরকারের তরফ থেকে নির্দেশ থাকার পরও গ্রার্মেন্টস কর্ত্রীপক্ষ তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেন নাই, বরং শ্রমিকদের তালাবদ্ধ করেই রাখছেন।

অপরদিকে এত এত দূর্ঘটনা ও শত শত প্রানহানীর পরও কোন গ্রার্মেন্টস কর্ত্রীপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় নাই। বরং গ্রার্মেন্টস মালিকরা ক্ষতিপুরন পাচ্ছে আর মাস না ঘুরতেই আহত-নিহত শ্রমিকদের কথা যাচ্ছে। তারা কিভাবে চিকিৎসা করছে, না বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছে তার খোজও কেউ করছে না। ১ টা দূর্ঘটনা ঘটে, কয়েক শত গ্রার্মেন্টস শ্রমিক মারা যায়, ১ বা ২ সপ্তাহ পেপার বা মিডিয়া কভারেজ দেয়, তারপর সব চুপ! ১ জন বা কয়েক শত গ্রার্মেন্টস শ্রমিকের জীবনের কোন মুল্যই নাই!!!

এভাবে চলতে দেয়া যায় না। গ্রার্মেন্টস মালিক বা কর্ত্রীপক্ষকে যথাযথ জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। আর ক্ষতিপুরন শুধু মালিকের জন্য নয়, শ্রমিকেরও প্রাপ্য। ১ জন শ্রমিকের জীবনের মূল্যের ক্ষতিপুরন ১ টি ছেগলে হবে না, শ্রমিককেও মানুষের মর্যাদা দিতে হবে।

২৩ এপ্রিল, ২০১৩

নীল বিদ্রোহঃ বাংলার একটি সফল বিদ্রোহ


তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' বইয়ে নীলকুঠির বর্ণনা যেভাবে ফুটে উঠেছে:
''সুচাঁদ বলে- বাবারা বলত, অ্যাই বড় বড় ঘোড়া, এই ঝালর দেওয়া সওয়ারি অর্থাৎ পালকি। এই সব বাংলা-ঘর, ফুল বাগিচা, বাঁধানো খেলার জায়গা, কাঠ-কাঠরার আসবাব; সে ঐশ্বর্যের কথা এক মুখে বলা যায় না। এক দিকে কাছারি গমগম করত, বন্দুক নিয়ে পাহারা দিত পাইক আটপৌরেরা- মাথায় পাগড়ি বেঁধে লাঠি নিয়ে বসে পাহারা দিত। জোড়হাত করে বসে থাকত চাষি সজ্জনেরা- ভয়ে মুখ চুন। দু-দশজনাকে বেঁধে রাখত। কারুর শুধু হাতে দড়ি, কারুর বা হাত-পা দুই-ই বাঁধা। সায়েব লোক, রাঙা রাঙা মুখ, কটা কটা চোখ, গিরিমাটির মত চুল, পায়ে অ্যাই বুট জুতো- খটমট করে বেড়াত, পিঠে 'প্যাটে' জুতোসুদ্ধ লাথি বসিয়ে দিত, মুখে কটমটে হিন্দি বাত- মারডালো, লাগাও চাবুক, দেখলাও শালোলোগকো সায়েব লোকের প্যাঁচ। কখনো হুকুম হত- কয়েদ কর। কখনো হুকুম হত- ভাঙ দেও শালোলোকের ধানকো জমি। লয়তো, কাটকে লেও শালোকে জমির ধান। সে তোমার বামুন নাই, কায়েত নাই, সদগোপ নাই- সব এক হাল। 'আতে' সারি সারি বাতি জ্বলত- টুং- টাং- ক্যাঁ- কোঁ- ভ্যাঁ- পো ভ্যাঁ- পো বাজনা বাজত, সায়েব মেম বিলিতি মদ খেত, হাত ধরাধরি করে নাচত, কয়েদখানায় মানুষ চেঁচালে হাঁকিড়ে উঠত বাঘের মত- মৎ চিল্লাও। বেশি 'আত' হলে সেপাইরা বন্দুকের রজ করত- দুম- দুম- দুম- দুম। হাঁক দিত- ও- হো- ই। তফাত যাও- তফাত যাও- চোর বদমাশ হুঁশিয়ার! চোরই হোক আর সাধুই হোক এতে ওদিকে হাঁটলে অক্ষে থাকত না, দুম করে গুলি করে দিত।''

প্রথমদিকে নীল চাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে ছিল। ১৮৩৩ সালের সনদ আইনের ফলে তাঁদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় আগমন করে ইচ্ছামত নীলের চাষ শুরু করে। তখন থেকেই কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। ফলে ১৮৫৯ সালে তারা নীল চাষ করতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে অস্বীকৃতি জানায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার কৃষক সম্প্রদায় নীল ব্যবসায়ী বা নীলকরদের বিরুদ্ধে একজোটে যে বিদ্রোহ করে। প্রথমদিকে এই আন্দোলন অহিংস ছিল, কিন্তু নীলচাষ না করার কারণে চাষিদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন, গ্রেপ্তার শুরু হলে এ আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। (১)

নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে 'নীল কমিশন' গঠন করে। এই কমিশন সরেজমিনে তদন্ত করে চাষিদের অভিযোগ যথার্থ বলে অভিমত দেয়। সরকার নীলচাষের ওপর একটি আইন পাস করেন। ফলে ১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। ১৯০০ সালে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণভাবে নীলচাষের অবসান ঘটে। (২)

নীল চাষের পটভূমি: প্রাচীন ও আধুনিক নীলচাষ
অতি প্রাচীন কালেও এদেশে নীল চাষ প্রচলিত ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতীয় ভেষজ বিজ্ঞানের নানা গ্রন্থে, প্রাচীন প্রতিমূর্তির বর্ণে, অঙ্কিত পট ও চিত্রে। ইংরেজিতে নীল indigo নামে আর গ্রিক ও রোমান ভাষায় indicum নামে পরিচিত। উভয় শব্দই india শব্দের সমার্থবোধক। আবার প্রাচীন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মাঝে নীলের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তারা বাস করত সিন্ধু নদের (the indus) তীরে এবং তাই ধারণা করা হয় এদেশেই নীল চাষের উৎপত্তি। (৩)
এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে নীলচাষ ও এর ব্যবহার প্রচলনের কৃতিত্ব একজন ফরাসি বণিক লুই বন্ড এর। তিনি ১৭৭৭ সালে আমেরিকা থেকে নীলবীজ ও আধুনিক চাষের পদ্ধতি এদেশে নিয়ে আসেন। একই বছরে সর্বপ্রথম তিনি হুগলী নদীর তীরবর্তী গোন্দালপাড়া ও তালডাঙ্গা গ্রামে নীলকুঠি স্থাপন করেন(৪)। কয়েক বছরের ভেতরে মালদহে, ১৮১৪ সালে বাকিপুরে, এবং তারপরে যশোরের ন'হাটা ও কালনাতে নীলকুঠি ও কারখানা স্থাপন করেন। ১৮২০ সালে কালনা থেকে প্রায় দেড় হাজার মণ পরিশোধিত নীল রপ্তানি করে বন্ড উপমহাদেশ ও ব্রিটেনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। ১৮২০ সালে তার মৃত্যু হয়। (৫)

বাংলায় নীলচাষের প্রসার:
লুই বন্ডের এক বছর পর ক্যারল ব্লুম নামের একজন ইংরেজ কুষ্টিয়ায় একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন(৬)। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নীলচাষে বিপুল মুনাফার কথা অবহিত করে দ্রুত নীলের কারবার শুরু করার আহ্বান জানান ও ১৭৭৮ সালে গভর্নর জেনারেলের কাছে এই বিষয়ে সপারিষদ একটি স্মারকপত্র দাখিল করেন(৭)। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় এবং কাপড় রং করার জন্য নীলের চাহিদা শতগুনে বেড়ে যায়। ফলে ওই সময়ে নীল চাষের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে ওঠে। কোম্পানি লাভের সম্ভাবনা দেখে শীঘ্রই সমস্ত কারবার হস্তগত করে নেয় এবং অত্যন্ত লাভবান হয়। এক হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৮০৩ সাল পর্যন্ত নীল চাষে যে খরচ হত, তার সবটাই কোম্পানি অল্প সুদে অগ্রিম প্রদান করত। এতে যে নীল উৎপাদিত হত, তার সবটাই যেত ইংল্যান্ডে এবং কোম্পানি বহুগুণ বেশি লাভ করত। এই ব্যবসা এতই লাভজনক প্রমানিত হয় যে, বহু কর্মচারী ও সরকারি আমলা চাকরি ও রাজনীতি ছেড়ে নীলচাষের কারবারে আত্মনিয়োগ করে। বহু দেশীয় জমিদার ও মহাজন ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথ মালিকানায় কারবার খোলে এবং দেখতে না দেখতে ১৮১৫ সালের মাঝে নদীয়া, যশোর, খুলনা, চব্বিশ পরগনা, বগুড়া, রাজশাহী, মালদহ, পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় অসংখ্য নীলকুঠি গড়ে ওঠে। এসব এলাকার নীলের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যবঙ্গের উৎকৃষ্ট নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী হবার কাহিনি সকল ধনিক ও বণিক সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করে এবং ক্রমশ ফরাসি, ডাচ, পর্তুগীজ, দিনেমার প্রভৃতি দেশের ধনিক গোষ্ঠীও দলে দলে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়।(৮)

নীল চাষের প্রসার দেখে বাংলার শীর্ষস্থানীয় মুৎসুদ্দি, নব প্রতিষ্ঠিত জমিদার গোষ্ঠী ও উদীয়মান শহুরে শ্রেণী নীলকরদের সুযোগ-সুবিধা ও নীলচাষের প্রসারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ সরকারের সুনজরে থাকা। এদের মাঝে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায় অন্যতম। তারা ১৮২৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে এক সভা করেন এবং নীল চাষ প্রসারের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ পাঠান। পার্লামেন্ট তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দাস মালিক ও দাস পরিচালনাকারীদের বাংলায় এনে নীলচাষের তদারকিতে নিয়োজিত করে। ব্যাপক নীল চাষের কারণে বিহার ও উড়িষ্যা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যে ইংরেজরা আগ্রা ও অয্যোধ্যা দখল করে।(৯)
বাংলাদেশের ২০ লক্ষ ৪০ হাজার বিঘা জমিতে ১২ লক্ষ ৮০ হাজার মণ নীল উৎপন্ন হত। বাংলায় ১১৬টি কোম্পানি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ৬২৮টি সদর কুঠির অধীনে সর্বমোট ৭৪৫২টি নীলকুঠি ছিল (ব্যক্তিগত ও দেশীয় জমিদার-মহাজনদের কুঠি বাদে)। নীলচাষে কর্মরত ছিল ১ কোটি ১২ লক্ষ ৩৬ হাজার কৃষক এবং নীলকুঠিগুলোতে নিযুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৪শ ৮২ জন। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধনের শতকরা ৭৩ ভাগ নীলের কারবারে লগ্নিকৃত ছিল।(১০)


নীল কুঠি ও কারবার পরিচালনা:
কোম্পানি গুলো একাধিক কুঠি স্থাপন করে ব্যবসা চালাত। তার মাঝে একটি কুঠিতে সমগ্র কারবার পরিচালনা করার জন্য একটি বোর্ড থাকত, এই কুঠিটিকে বলা হত সদর কুঠি বা কনসার্ণ। সদর কুঠিতে অবস্থিত পরিচালনা বোর্ড প্রতি কুঠিতে একজন ম্যানেজার বা অধ্যক্ষ নিয়োগ করত। তাঁকে বলা হত বড় সাহেব এবং তার সহকারিকে বলা হত ছোট সাহেব। এই পদ দুইটি সর্বদা শ্বেতকায় লোকদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। বাকি পদগুলো ছিল দেশীয় লোকদের জন্য। ছোট সাহেবের পর যার সর্বোচ্চ পদমর্যাদা ছিল, তাঁকে বলা হত দেওয়ান বা নায়েব। অনেক ক্ষেত্রে এই পদটিও একজন ইংরেজ বা শ্বেতকায় ব্যক্তি দখল করত। দেওয়ানের একাধিক সহযোগী থাকত। এসব সহযোগী প্রজা ও অন্যান্য নিম্নপদস্থ কর্মচারীর সাথে সাহেবদের যোগাযোগ রক্ষা করত। তাদের প্রধান কাজ ছিল হিসাবপত্রের নানা কাজ করা। দেশীয় কর্মচারীদের মাঝে এরাই সর্বাপেক্ষা লাভবান হত। কারণ হিসাবে গরমিল, সই জালকরণ, ঘুষ গ্রহণ ও সুদের কারবারি করে এরা প্রজাদের কাছ থেকে প্রভূত অর্থোপার্জন করত।(১১). এরপর ছিল পর্যায়ক্রমে গোমস্তা, আমিন, সরকার, তহসিলদার, মাহুত, সহিস, বরকন্দাজ, ওজনদার, পেয়াদা, জমাদার, তাগিদগীর, চৌকিদার, মালি প্রভৃতি অসংখ্য নিম্নপদের কর্মচারী। 
বেতনের ক্ষেত্রে, দেশি দেওয়ানের বেতন ছিল মাসে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ১৭ টাকা পেত গোমস্তা। আমিনের কাজ ছিল জমির সীমানা বের করা ও মাপজোক করা। সে বেতন পেত ১৪ টাকা। সরকার ও তহসিলদারের বেতন ছিল ১১ টাকা। মাহুত ও সহিস পেত ৭ টাকা। বাকি কর্মচারীরা কোন বেতন পেত না, তবু তারা চাকরি করত কারণ তারা সাধারণ মানুষকে শোষণ করত। নীল পরিমাপের জন্য ওজনদার এবং রায়তদের কাজে তাগিদ দেবার জন্য তাগিদগীর ছিল। তাগিদগীর যথাসময়ে নীলবীজ ও দাদন গ্রহনের জন্য কৃষক প্রজাদের সংবাদ পৌঁছে দিত এবং বৃষ্টির পর কোন জমিতে নীল বুনতে হবে, তা জমিতে 'দাগ' মেরে নির্দিষ্ট করে দিত(১২)। পুলিশের কাজ করত পেয়াদা। কাউকে ধরে আনা এবং শাস্তি প্রদান করা তার কাজ ছিল। সম্ভবত গোমস্তার পর পেয়াদাই সবচেয়ে জুলুমবাজ কর্মচারী ছিল(১৩)। কুলি ও মজুরদের কাজ দেখাশোনা করত জমাদার। সহরত ও ইস্তেহার ইত্যাদি জারি করত চৌকিদার। বরকন্দাজ ছিল কুঠির লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান (১৪)(১৫)। এসব কর্মচারির অধিকাংশই মুসলিম সমাজ থেকে আগত ছিল, যদিও তুলনামূলক উচ্চ পদগুলো ছিল হিন্দুদের দখলে।

নীলচাষের প্রাথমিক অসুবিধা ও প্রতিকার:
 লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বহু হিন্দু সরকারি কর্মচারীকে এদেশের জমির মালিক করে দেন। এরা নিজ জমিদারি সীমার মাঝে ছোটখাটো রাজা-বাদশার মত ক্ষমতা ভোগ করত। এরা জমি তো বটেই, প্রজার জানমাল, এমনকি তাঁদের ইজ্জত-সম্ভ্রমের মালিকও ছিল(১৬)। ইংরেজরা এদেশে এসে এই ভূস্বামী শ্রেণীটিকে তাঁদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে দেখতে পেল। কারণ, তারা যদি জমি কিনেও নিত, তবুও প্রজারা ওই ভূস্বামীদের অধীনে থাকত। ফলে জমিদারের অধীন প্রজাকে দিয়ে নীলকররা ইচ্ছেমত কাজ করিয়ে নিতে পারত না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিগণ প্রভাব বিস্তার করে ১৮১৯ সালে অষ্টম আইন(Eighth regulation of 1819) বলবৎ করেন। এই আইনে জমিদার নিজের ভূমির ভেতর 'পত্তনি তালুক' দেবার সুযোগ পায়। অধিক মুনাফার আশায়, আবার কোথাও অত্যাচার বা জুলুমের ভয়ে নীলকরদের কাছে বড় বড় পত্তনি দিতে শুরু করে। এদের মাঝে প্রসন্নকুমার ঘোষণা করেন, 'আলস্য, অনভিজ্ঞতা ও ঋণের জন্য দেশীয় জমিদারগন জমি পত্তনি দিতে উদগ্রীব হন, কারণ ইহাতে তাহারা জমিদারি চালাইবার ভার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং জমি পত্তনিদানের মত একটি নিশ্চিত আয়ের সাহায্যে রাজধানী কিংবা কোন একটা বড় শহরে বাস করিতে পারেন। এবং ইহাই রায়তদের জন্যে কল্যাণকর'(১৭)। পত্তনি ব্যবস্থায় জমিদারকে উচ্চহারে সেলামি ও খাজনা দিতে হত, বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য জমিস্বত্ব এবং দৈনিক মজুরির বিনিময়ে প্রজার সেবা পাওয়া যেত, যা ছিল অত্যন্ত খরচসাধ্য। তাই খরচ কমাতে নীলকরদের বাঁকুড়া, বীরভূম, সিংভূম, ধানভূম, মানভূম প্রভৃতি দূরবর্তী এলাকা থেকে শ্রমিক এনে কাজ করাতে হত। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কুঠিয়ালরা জমিদারি হস্তগত করার চেষ্টা করতে থাকে। ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ার সনদে চতুর্থ আইনের(fourth regulation of 1833) দ্বারা বাংলাদেশে ইংরেজদের জমি ও জমিদারি ক্রয়ের সুযোগ প্রদান করা হয়। অনেক জমিদার অধিক মূল্য পেয়ে, কেউবা দুর্ধর্ষ নীলকর বা ম্যাজিস্ট্রেটের হুমকি পেয়ে জমিদারি বিক্রি করে চলে যায়। যারা এর আগে পত্তনি বন্দোবস্ত দিয়েছিল, তারা আর কখনো তালুক বা জমিদারি ফেরত পায়নি। অনেক জমিদার পাশের জমিদারের সাথে শত্রুতা করে জব্দ করার জন্য নীলকরদের ডেকে আনত। কিন্তু পরবর্তীতে নীলকররা উভয়ের জমিই গ্রাস করে নিত। এভাবে বাংলার সর্ববৃহৎ নীল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান 'বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি' কেবল চুয়াডাঙ্গা, ঝিনেদা, রানাঘাট ও যশোর থেকেই ৫৯৪টি গ্রামের জমিদারি ক্রয় করে। এই বিশাল জমিদারি থেকে তারা ব্রিটিশ সরকারকে রাজস্ব দিত মাত্র ৩ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা, যেখানে কেবল চুয়াডাঙ্গা ও রানাঘাট এলাকায় এরা ১৮ লক্ষ মূলধন খাটাত। মূলতঃ এই ভাবে ইংরেজগণ অধিকাংশ জমিদারি ক্রয় করে বাংলায় জেঁকে বসে ও নীল চাষ শুরু করে।(১৮)

কুঠি স্থাপন ও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নীলকুঠি:
১৮১৫ সালের মাঝে সারা বাংলাদেশে প্রায় সমস্ত অঞ্চলে নীল ব্যবসা প্রসার লাভ করে ও নীলকুঠি স্থাপিত হয়। ১৭৯৫ সাল থেকে যেসব নীল কারবারি ও ব্যবসায়ী এদেশে কুঠি স্থাপন করে কারবারি শুরু করেন, তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন -

১৭৯৫ সালে মিঃ সি. ডব্লিউ. শেরিফ জোড়াদহে
১৭৯৬ সালে মিঃ জন রিভস ও শেরিফ যৌথ মালিকানায় সিন্দুরিয়ায়
১৭৯৬ সালে মিঃ টাপট মহম্মদশাহীতে
১৮০০ সালে মিঃ ফারগুসন ও মে সাহেব যৌথ মালিকানায় যথাক্রমে দহকোলা ও আলমপুরে
১৮০০ সালে মিঃ টেলর মহেশপুরে
১৮০১ সালে মিঃ বার্কার সাহেব চুয়াডাঙ্গার নিশ্চিন্তপুরে
১৮০১ সালে মিঃ অ্যান্ডারসন যশোরের বারিন্দি ও বারুই পাড়ায়(১৯)
১৮০৫ থেকে ১৮১৫ সালের মাঝে যারা নীল কুঠি স্থাপন করেন-
মিঃ টেলর ও ন্যুডশন - মিরপুরে
মিঃ রিজেট - ন'হাটায়
মার্টিন কোম্পানির ম্যানেজার মিঃ স্টিভেনসন - কুষ্টিয়ার আমবাগানে
মিঃ জেনকিনস ও ম্যাকেঞ্জি - ঝিকরগাছায়
মিঃ ওয়াটস - গোস্বামী দুর্গায়
মিঃ ডেভরেল - ঝিনেদার পার্শ্ববর্তি হাজরাপুরে(২০)

দেশি জমিদার ও মুৎসুদ্দিদের মাঝে অনেকেই ইংরেজ কুঠিয়ালদের দেখাদেখি নিজ এলাকায় নীল ব্যবসা শুরু করেন। তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ক'জন হলেন -
জমিদার অবনীমোহন বসুঃ ইনি প্রজা পীড়নের জন্য কুখ্যাত ছিলেন। তার সদর কুঠি ঘোড়াখালিতে অবস্থিত ছিল। তিনিই দেশীয় জমিদারদের মাঝে সর্বপ্রথম ইংরেজ ম্যানেজার রাখেন।
হরিচরণ সাহাঃ চুয়াডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী শ্রীকোল বোয়ালিয়ার মহাজন। ইনি একটি ছোটখাটো নীলকুঠি স্থাপন করে নীলের ব্যবসা শুরু করেন এবং সেই বছরই একটি কুঠি থেকে সর্বোচ্চ নীল উৎপাদনের রেকর্ড করেন।
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কালিপ্রসন্ন সরকারঃ ইনি চাকরি ছেড়ে আর. এস. পাউরান-এর কাছ থেকে মদনধারী সদর কুঠি কিনে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
রাজা প্রমথভূষণঃ নলডাঙ্গার রাজা। এদেশীয় রাজাদের মাঝে সর্বপ্রথম নীলচাষ শুরু করেন তিনি। তার অত্যাচার এতই জঘন্য ছিল যে কৃষকেরা সেটা নিয়ে গানও বেঁধেছিল-

'আহা একটুখানি চাঁদেরে ভাই মাঠ করেছে আলো,
বেলে দাড়ি নীল বুনিলাম নীল হল না ভাল।
বাবুর ঘোড়া জোড়া জোড়া নীল দেখিতে যায়,
নীল দেখিতে পেয়ে বাবুর ব্যর্থ হাসি পায়।
ব্যর্থ হাসি, মুখে বাঁশি, চাঁদ খাঁর বাড়ি
চাঁদ খাঁ চাঁদ খাঁ বসে কর কি?
তোমার পুত্র মার খাচ্ছে নলডাঙ্গার কাছারি।
আর মেরো না আর মেরো না ফুলো বেতের বাড়ি,
কাল পরশু দিয়ে যাব দাদনের কড়ি,
নীল বুনিব নলে গাবো আসবো তাড়াতাড়ি।'(২১)

এছাড়া আচার্য মথুরনাথ(সাধুহাটির জমিদার), রঘুপতি মজুমদার(পথহাটির দিকপতি), শ্রীহরি রায়(চণ্ডীপুরের জমিদার), আশুতোষ গাঙ্গুলি(পোতাহাটির নায়েব) প্রভৃতি নীল চাষ করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন।
নীল বিদ্রোহের শুরু হয় চুয়াডাঙ্গার চূর্ণী বা মাথাভাঙ্গার তীরবর্তী কতগুলো গ্রাম থেকে। কারণ এসব এলাকায় সর্বোচ্চ মানের নীল উৎপন্ন হত, তাই বেশি বেশি উৎপাদনের আশায় নীলকরেরা অত্যাচারও বেশি করত।
এখানকার প্রধান একটি কুঠির বর্ণনা দেয়া হল।
সিন্দুরিয়া সদর কুঠিঃ সাবেক চুয়াডাঙ্গা মহকুমাকে নীলকররা ৬টি সদর কুঠিতে ভাগ করে -

১.সিন্দুরিয়া সদর কুঠি
২.নিশ্চিন্তপুর সদর কুঠি
৩.চণ্ডীপুর সদর কুঠি
৪.খাল বোয়ালিয়া সদর কুঠি
৫.লোকনাথপুর সদর কুঠি
৬.কাঁচিকাটা সদর কুঠি

এদের মাঝে সিন্দুরিয়া সদর কুঠি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও উৎপাদনশীল ছিল। মোট ১৬ হাজার ৬শ ৫২ বিঘা জমিতে বছরে ১০০০ মণ নীল উৎপাদিত হত। চাষি ও কর্মচারীর মোট সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ২৬ হাজার ৩শ ৬৮ জন।
সিন্দুরিয়া নীলকুঠির প্রথম মালিক ছিলেন জেমস আইভান মে। ১৭৯৩ সালে তিনি কুঠি নির্মাণে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণে তাঁকে ফিরে যেতে হয়(২২)। এর পরে মিঃ জন রিভস দায়িত্ব নেন, কিন্তু তিনিও কুঠি নির্মাণে ব্যর্থ হন(২৩)। তিনি স্থান পরিবর্তন করে কুঠিটি মর্তুজাপুর এবং হিঙ্গের পাড়া গ্রামের মাঝে নিয়ে আসেন। মিঃ শেরিফ কুঠির মালিকানার অংশীদার হন। কুঠির ম্যানেজার হিসেবে মিঃ জর্জ ম্যাকনেয়ার দায়িত্ব পান। কুঠির দক্ষিণাংশ তখন সম্পূর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ ছিল(২৪)। পরে এখানে কর্মচারীদের জন্য একটি দালানবাড়ি স্থাপন করা হয়।
সিন্দুরিয়া সদর কুঠিতে একেবারে শুরুতেই প্রজা বিদ্রোহ দেখা দেয়। উৎপাদন বন্ধ হবার উপক্রম হয়। ক্ষতির আশঙ্কা দেখে রিভস কারবার ম্যাকনেয়ার ও শেরিফের কাছে বিক্রি করে ইংল্যান্ডে চলে যান।  তখন থেকেই ম্যাকনেয়ার কারবারে লাভ করতে থাকেন। অনেকে বলেন, শেরিফ ও ম্যাকনেয়ারের ষড়যন্ত্র করে এই কুঠিতে বিদ্রোহ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। ম্যাকনেয়ার বহুসংখ্যক কর্মচারী ছাঁটাই করেন, চাষিদের নতুন চুক্তির আওতায় আনেন, সেই সাথে পেয়াদার সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। ফলে ১৮৫৮-৫৯ সালে চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে তার কুঠি সর্বোচ্চ নীল উৎপাদন করে। কুঠিতে পূর্বেই ৮ কক্ষবিশিষ্ট সুরম্য প্রাসাদ, নীল হাউস, সেরেস্তার কাজ চালানোর জন্য কাছারি, নাচমহল, গোরস্থান, মৃত্যুকূপ, ঘোড়দৌড়ের মাঠ এবং কর্মচারীদের বাসস্থান তৈরি করা ছিল। তিনি নতুন করে সচিবালয়(২৫), পিলখানা, গুটিপোকা চাষের জন্য দালান, হাতিশাল তৈরি করেন এবং ১৮৬৩ সালে কুঠিতে পুকুর খনন করেন।
তিনি চাষিদের কাছারি ঘরে এনে নির্যাতন চালাতেন। প্রায়ই চাষির মেয়ে বা স্ত্রীকে ডেকে নেওয়া হত সাহেবের গুপ্তকক্ষে(২৬)। চাষি ভাগ্যবান হলে জীবন্ত অবস্থায় তার স্ত্রীকে, তার মেয়েকে ফেরত পেত। নইলে পুরো পরিবারকে খুন করে ফেলে দেওয়া হত মৃত্যুকূপে। ম্যাকনেয়ারের মানসিকতায় বিকৃতি ছিল প্রচণ্ড(২৭)। তিনি ১৮৫২ সালে দুর্গাপুর, আটলে, খাড়াগোদা ও সিন্দুরিয়া অঞ্চলের সমস্ত খেজুর গাছ ও বাগান উৎপাটিত করে নীল আবাদের জন্য জোরপূর্বক জমি তৈরি করেন। পরবর্তীতে তার পাশবিক আচরণ এই অঞ্চলে নীল বিদ্রোহের অন্যতম প্রভাবক হয়ে ওঠে।

পীড়ন ও বিদ্রোহের সূচনাঃ নীলচাষে শোষণ:
১৮৩৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে আইনবলে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়। যে সব কর্মচারী সেখানে রবার চাষে ক্রীতদাসদের ওপর নৃশংস অত্যাচার চালাতে অভ্যস্ত ছিল, তাঁদের বঙ্গদেশে এনে নীলকর বানিয়ে দেওয়া হয়। তারা এখানে এসে নীল ব্যবসায়ী, মহাজন, জমিদার এমনকি অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ দখল করে। তাই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারি হয়ে তারা এদেশের সাধারণ কৃষকের ওপর যে সীমাহীন অত্যাচার চালায়, তার সমতুল্য মর্মান্তিক ঘটনা আজো বিরল।

নীলকরদের সামনে প্রজারা ছিল অসহায়। আইন-আদালত তো দূরের কথা, তাঁদের সাথে নবাব-বাদশাদেরই সংস্রব ছিল না। এমতাবস্থায় তারা নিরুপায় হয়ে দাদনী চুক্তিপত্রে টিপসই দিত এবং নীল চাষ করতে বাধ্য হত। দাদনী চুক্তিপত্র বা একরারনামা ছিল একটুকরা সাদা কাগজ, যার ওপরে প্রথমে কৃষকের টিপসই নেওয়া হত, তারপর গোমস্তাকে দিয়ে ইচ্ছেমত শর্তাদি লিখিয়ে নেয়া হত। এসম্পর্কে এক ইংরেজ লেখক বলেন,
'The cold, hard and sorbid who can plough up grain fields, kidnap recusant rayets, confine them in dark holes, beat and starve them into submission, which things have sometimes been done, can give no moral guarantee of his capability of filling up a blank paper and turning it to his precuniary profit.'(২৮)
এই চুক্তিপত্রে কৃষকের সকল উৎকৃষ্ট জমির কথা লেখা থাকত, কিন্তু সে তা জানতে পারত না। সারা বছর সার-মাটি দিয়ে, লাঙল চষে, বৈশাখ মাসে মাঠে ধানের বীজ নিয়ে গিয়ে কৃষক দেখত তার জমিতে খুঁটি গেঁড়ে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এই জমিতে নীল চাষ করতে হবে। সন্ধ্যাবেলা তাগিদগীর এসে জানিয়ে যেত কৃষক যেন ভোরে গিয়ে নীলের বীজ ও দাদনের টাকা নিয়ে আসে। অন্যথা হলে তাঁকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হত।

প্রশ্ন উঠতে পারে, যেখানে দাদনের টাকা ও বীজ দেওয়া হত, সেখানে নীল চাষে ক্ষতি কোথায়?
প্রথমতঃ, নীল ছাড়া অন্য কোন শস্য চাষ করার জন্য জমি চাষির হাতে থাকত না। দ্বিতীয়তঃ, সোজা কথায় বলা যায়, ৩৩ শতাংশ বা এক বিঘা নীল চাষ করে চাষির খরচ হত ৩ টাকা। আর আয় হত ১ টাকা। ফলাফল? প্রতি বিঘায় ক্ষতি ২ টাকা। অন্য কোন জমিতে ধান পাট চাষের জন্য অনুমতি না থাকায় কৃষক এই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ করতে পারত না। তাঁকে টাকা ধার করতে হত। এভাবে কৃষকের পিঠে ঋণের বোঝা ক্রমে ক্রমে আরও বাড়ত।
নীলকরের হিসাব করলে দেখা যায়, ১৮৪০ সাল পর্যন্ত প্রতি টাকায় ১০ আঁটি নীলের দর ছিল। ১০ বাণ্ডিলে নীল থাকত আড়াই সের। ২৩০ টাকা মণ দরে আড়াই সের নীলের দাম ছিল ১৩ টাকা ৬ আনা। চাষিকে ১ টাকা দিয়ে নীলকরের লাভ হত ১২ টাকা ৬ আনা! ১৮৪০ সালের পর তীব্র আন্দোলনের মুখে টাকায় ৪ বাণ্ডিল মূল্য নির্ধারিত হয়। এতে চাষি পেত ২ টাকা আর নীলকরের লাভ থাকত ১১ টাকা ৬ আনা, বা মণে ১৯৪ টাকা। জেমস ওয়াটস তার বইয়ে নীল ব্যবসার মুনাফা দেখিয়েছেন পুরো ১০০ শতাংশ(২৯)। 'Indian Field' পত্রিকায় প্রকাশিত এক হিসাবে দেখানো হয়, যে পরিমান নীলের জন্য চাষি পায় ২০০ টাকা, তা থেকে নীলকর পায় ১৯৫০ টাকার রং। যদি রং প্রস্তুতের জন্য আরও ২০০ টাকা খরচ হয়, তবু তার লাভ থাকে ১৭৫০ টাকা(৩০)।

বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাশলি ইডেন নীল কমিশনের কাছে তামাক ও নীলচাষের তুলনামূলক একটা হিসাব দাখিল করেন। তা থেকে দেখা যায়ঃ
নীল উৎপাদনে ব্যয়
খাজনা ০৩ টাকা
৮ মাসে লাঙলের খরচ ০৮ টাকা
সার ০১ টাকা
বীজ ১০ আনা
নিড়ানি ০৪ আনা
গাছ কাটা ০৮ আনা
----------------------------------------------
মোট খরচ ১৩ টাকা ৬ আনা
উৎপন্ন নীলের বিক্রয়মূল্য ০৪ টাকা
---------------------------------------------
অতএব, ক্ষতি ৯ টাকা ৬ আনা

একই জমিতে তামাক উৎপাদনের ব্যয়
খাজনা ০৩ টাকা
লাঙল ০৮ টাকা
নিড়ানি ০৬ টাকা
সার ০১ টাকা
সেচ ০১ টাকা
অন্যান্য ০৫ টাকা
----------------------------------------------
মোট খরচ ২৪ টাকা
উৎপন্ন তামাকের বিক্রয়মূল্য ৩৫ টাকা
----------------------------------------------
অতএব, লাভ ১১ টাকা

অ্যাশলি ইডেন তার মন্তব্যে লিখেছেন, 'রায়েত নিজের জমিতে স্বাধীনভাবে তামাক চাষ করতে পারলে সে যা লাভ করতে পারত তার সাথে নীলচাষের জন্য তার যা ক্ষতি হয়েছে, তা যদি যোগ করা হয়, তাহলেও রায়তের ক্ষতি থাকে ২০ টাকা ৬ আনা। ১৮৫৮ সালে তামাকের মূল্য ছিল ১৮ টাকা। এই মূল্য ধরলে তামাক চাষে প্রজার লাভ হতে পারত ১০১ টাকা ১৪ আনা'(৩১)।
নীলকররা কৃষকের জমি মেপে সে অনুযায়ী দাদনের টাকা দিত। কিন্তু যে মাপদণ্ড দিয়ে মাপা হত, তা প্রকৃত মাপের চেয়ে অনেক দীর্ঘ ছিল। চাষির ১১ বিঘা মাপদণ্ডে দেখাত ৭ বিঘা(৩২)। চুক্তিপত্রের স্ট্যাম্পের দাম দিত কৃষক। নীলগাছ কুঠিতে পৌঁছে দেবার ভাড়া দিত কৃষক। দেরি হলে পেয়াদার দল এসে কৃষকের খাসি-মুর্গি-ছাগল ধরে নিয়ে যেত, আম, কাঁঠাল, লিচুর গাছ কেটে তছনছ করে দিত। নীলক্ষেতে যে ঘাস জন্মাত, তার ওপরেও কৃষকের কোন অধিকার ছিল না। ভুলে গরু ছাগল ছুটে ক্ষেতে গেলে পাহারাদার সেগুলো ধরে জব্দ করে ফেলত(৩৩)। সরকারও এই অত্যাচারে মদদ দেয়। ১৮৩০ সালে আইন জারি হয়, যারা নীলচুক্তি ভঙ্গ করবে, তাঁদের ফৌজদারি আইনে সোপর্দ করা যাবে ও সম্পত্তি ক্রোক করা যাবে। এভাবে নীলচাষে লোকসান দিয়ে, অর্থকারী ফসল-গবাদিপশু-গাছপালা হারিয়ে নিরন্ন, বিবস্ত্র ও অসহায় হয়ে যেত মহাজনের কাছে। কিন্তু মহাজনের পুরো ঋণ শোধান তো দূরের কথা, সুদের টাকাও তাঁর দেবার সামর্থ্য হত না। একদিন দেখা যেত আদালতের ডিক্রিবলে মহাজন তার ভিটেমাটি, পৈতৃক জমি দখল করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পথে। আর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাই একদিন রুখে দাঁড়ালো কৃষকেরা।

নীল বিদ্রোহের শুরু ও কয়েকটি ঘটনা :

দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ১৮৫৮ সালে অসহযোগ আন্দোলনে পরিণত হয় এবং ১৮৫৯ সালে বিদ্রোহ হয়ে বেরিয়ে আসে। এর আগেও চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার। যেমন Calcutta Review পত্রিকায় বলা হয়েছে, সর্বপ্রথম ১৮৪৪ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারি নীলকুঠিতে মানুষ খেপে ওঠে এবং আগুনে কুঠিটিকে ভস্মীভূত করে(৩৪)। এভাবে যেখানেই নেতৃত্ব ও সংগঠন গড়ে ওঠে, সেখানেই শুরু হয় প্রতিবাদ, বিদ্রোহ।

নীল বিদ্রোহের পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো হলঃ
ক. নীলকরদের নির্দিষ্ট উচ্চহার বা বর্ধিত খাজনা দিতে এবং জমি বন্দোবস্ত গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ
খ. সাদা কাগজের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি
গ. নীলবীজ ও দাদনের টাকা গ্রহণে অস্বীকৃতি
ঘ. অত্যাচার থামাতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ
ঙ. সংবাদপত্র, নাটক, লোকগান, ছড়া ইত্যাদির মাধ্যমে নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা ও প্রচার করা
চ. দলবেঁধে নীলচাষ বন্ধ করা
ছ. নীলগাছ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলে অন্য ফসল বোনা
জ. লাঠিয়াল বাহিনী সংগঠন এবং নীলকরদের পেয়াদা ও পাহারাদারদের পর্যুদস্তকরণ
ঝ. সশস্ত্র অভ্যুত্থান
ঞ. সবশেষে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই এবং নীলকরদের উচ্ছেদ

ঠিক কোথায় প্রথম বিদ্রোহের সূচনা তা নিয়ে নানা মত বিদ্যমান। অধিকাংশই মনে করেন যে, চূর্ণী নদীর তীরবর্তী চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের খাল বোয়ালিয়া ও আসাননগর কুঠিতে সর্বপ্রথম এই বিদ্রোহ শুরু হয়। কারো মতে চৌগাছা কুঠিতে এর সূত্রপাত। বাকল্যান্ড সাহেবের মতে, উত্তরবঙ্গে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। তার মতে, আওরঙ্গবাদ মহকুমার এন্ড্রোজ কোম্পানির আঙকারা নীলকুঠির ওপরে সর্বপ্রথম আক্রমণ করার মাধ্যমে বিদ্রোহ শুরু হয়। তবে বিদ্রোহ যে বাংলাদেশে শুরু হয়, তা সম্পর্কে সবাই একমত। সাধারনতঃ বলা হয় যে, অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন মালদহ জেলার কৃষকগণ এবং তার পূর্ণতা সাধন করেন উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা। আর সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন টাঙ্গাইলের কাগমারির কৃষকেরা এবং পূর্ণতা সাধন করেন চুয়াডাঙ্গা এলাকার কৃষকগণ(৩৫)।
দুর্গাপুরের পিয়ারি মণ্ডলের রসিক প্রতিবাদ(৩৬), সিন্দুরিয়া নীলকুঠির গোমস্তা শীতল বিশ্বাসের হত্যা(৩৭), রব্বানি মণ্ডলের ওপরে অত্যাচার(৩৮) -এর মত ঘটনা নীল বিদ্রোহের অসহযোগ পর্যায়কে আরও বেগবান করে এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে দেয়। এই বিদ্রোহ মূলত শুরু হয় ১৮৫৯ সালে, বাস্তব রূপ পরিগ্রহন করে ১৮৬০ সালে এবং ১৮৬১ সালে প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। অসহযোগ এই আন্দোলন ঠেকাতে কুঠিয়াল ও জোতদাররা লাঠিয়াল বাহিনী নামায় ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে, ফলে ১৮৫৯ সালের শেষে বা ১৮৬০ সালের শুরুতে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহের কেন্দ্রে ছিল কৃষকদের লাঠিয়াল বাহিনী।

বাহিনী গঠন ও রণকৌশল
১৮৬০ সালের এপ্রিলে 'ইন্ডিয়ান ফিল্ড' নামক মাসিক পত্রিকায় দু'জন জার্মান পাদ্রি চুয়াডাঙ্গার বিপ্লবীদের লাঠিয়াল বাহিনী সম্পর্কে লেখেন,
'অপটু কৃষক যোদ্ধাগণ নিজেদের ৬টি কোম্পানিতে বিভক্ত করেছে। ১ম কোম্পানি তীরন্দাজদের নিয়ে গঠিত। ২য় কোম্পানি গঠন করা হয় প্রাচীনকালের ডেভিডের মত ফিঙা দিয়ে গোলোক নিক্ষেপকারীদের নিয়ে। ইটওয়ালাদের নিয়ে ৩য় কোম্পানি। এরা পরিধেয় লুঙ্গিতে মাটির বড় বড় ঢেলা, ইট-পাটকেল বহন করে এবং ছুঁড়ে মারে। ৪র্থ কোম্পানি গঠিত বেলওয়ালাদের নিয়ে, যাদের কাজ হল নীলকরদের লাঠিয়াল বাহিনির মস্তক লক্ষ করে শক্ত কাঁচা বেল ছুঁড়ে মারা। থালা-ওয়ালাদের নিয়ে ৫ম কোম্পানি। তারা ভাত খাবার কাঁসা ও পিতলের থালাগুলো আনুভূমিকভাবে চালাতে থাকে। এতে শত্রু নিধন যে ভালভাবেই হয় তাতে সন্দেহ নেই। ৬ষ্ঠ কোম্পানি মহিলাদের নিয়ে গঠিত হয়। তারা হাতে মাটির পোড়ান খণ্ড, মাটির বাসন ও রুটি বেলার বেলন নিয়ে আক্রমণ করে থাকে। প্রথমে তারা লাঠিয়ালদের দিকে মাটির খণ্ড ও বাসনকোসন ছুঁড়ে মারে। এতে লাঠিয়াল যদি ভূপাতিত হয়, তখন তাঁকে বেলনপেটা করা হয়।'
'আর যারা যুদ্ধে পটু, তাদের নিয়ে মূল কোম্পানি গঠিত। এরাই কৃষক লাঠিয়াল, এরা সম্মুখ সমরে অংশ নেয়। এই কোম্পানির অর্ধেক বল্লমধারী, অর্ধেক লাঠিধারী। সবার সামনে থাকে বল্লমধারি, তাঁদের পর লাঠিয়ালরা, এবং তারপর বাকি পাঁচ কোম্পানি। এদের বীরত্ব কিংবদন্তিসম। একজন বল্লমধারি নাকি ১০০ জন শত্রুপক্ষীয় যোদ্ধাকে পরাজিত করতে পারে। সংখ্যায় এরা কম হলেও এতটাই দুর্ধর্ষ যে, তাঁদের ভয়ে নীলকরের লাঠিয়ালগণ পুনরায় আক্রমণ করতে সাহস করছে না'(৩৯)।

তখন কৃষকদের মূল শক্তি ছিল এই লাঠিয়াল-বল্লম বাহিনী। লাঠি চালনা শিক্ষার জন্য প্রধান ঘাঁটি ছিল বরিশাল, রংপুর ও টাঙ্গাইল। এখানকার ওস্তাদেরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন এবং জায়গায় জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। তখন লাঠি চালনা শেখাটা ছিল গৌরবের বিষয় ও পৌরুষের প্রমাণ। কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে লাঠিয়ালরা তখন বীরদর্পে সুসজ্জিত শত্রুবাহিনীর আক্রমণ ঠেকিয়েছে এবং তাঁদের ঠেঙিয়েছে। তবে কৃষকদের অস্ত্র অঞ্চলভেদে ও বাহিনীভেদে কমত-বাড়ত। অনেক অঞ্চলে 'পলো বাহিনী' ছিল। তারা পলো ও ঝাঁকজাল কাঁধে নিয়ে এবং হাতে জুতি ও কোঁচ নিয়ে অগ্রসর হত। প্রমোদ সেনগুপ্ত বলেন, 'নানা অঞ্চলে নানা বাহিনী চালু ছিল। কোন কোন অঞ্চলে তীর, ধনুক, বন্দুক ও আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত বাহিনী ছিল। এদের মাঝে পাবনার নীল বিদ্রোহীরা সর্বপ্রথম বন্দুক ব্যবহার করে।'
এছাড়া ছিল তিতুমিরের 'হামকল বাহিনী' এবং ফরায়েজি আন্দোলনের অনুসারীদের 'দুন্দুভি বাহিনী'-র কথাও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুইটি বাহিনী ও কৃষক বাহিনির বিদ্রোহের এজেন্ডা ভিন্ন হলেও এই বাহিনীত্রয়ের লক্ষ ছিল একটাই- অত্যাচারি নীলকর ও জমিদারদের ধ্বংস। তিতুমিরের হামকল বাহিনির ব্যারাক ছিল হুলিয়ামারিতে। এই হামকল বাহিনী ভারি কাঠের মুগুর ব্যবহার করত ও বাঁশ দিয়ে তৈরি নানা ধরনের যন্ত্র তৈরি করত- যা নীলকরদের কুঠি ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। যেখানেই গোলাবাড়ি ও নীলকুঠি ছিল, সেখানেই এই বাহিনী তাঁদের কর্মতৎপরতা বজায় রাখত। নীল বিদ্রোহে এমন কোন লড়াই হয় নি, যেখানে হামকল বাহিনী অংশগ্রহণ করেনি(৪০)।

আর দুন্দুভি বাহিনী সম্পর্কে অনাথনাথ বসু লিখেছেন, 'নীলকরের লাঠিয়াল হইতে আত্মরক্ষার এক অপূর্ব কৌশল কৃষকগণ আবিস্কার করেন। প্রত্যেক পল্লীর প্রান্তে একটি করিয়া দুন্দুভি রাখিয়াছিল। যখন কুঠিয়ালগণের লাঠিয়ালরা গ্রাম আক্রমনের উপক্রম করিত, কৃষকগণ তখন দুন্দুভি ধ্বনি দ্বারা পরবর্তী গ্রামের রায়তগণকে বিপদের সংবাদ জ্ঞাপন করিলেই সকলে আসিয়া দলবদ্ধ হইত(৪১)। সতীশচন্দ্র লিখেছেন, 'গ্রামের সীমানায় এক স্থানে একটি ঢাক থাকিত। নীলকরের লোক অত্যাচার করিতে আসিলে কেহ সেই ঢাক বাজাইয়া দিত। অমনি শত শত গ্রাম্য কৃষক লাঠিসোঁটা লইয়া দৌড়াইয়া আসিত। নীলকরের লোকেরা প্রায়ই অক্ষত দেহে পলাইতে পারিত না। সম্মিলিত প্রজা শক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়া সহজ ব্যাপার নহে'(৪২)।

সশস্ত্র বিদ্রোহের শুরু ও কিছু ঘটনা:
কৃষকেরা অসহযোগ আন্দোলনের এক পর্যায়ে নীলচাষে অস্বীকৃতি জানিয়ে হাজার হাজার চুক্তিপত্র পুড়িয়ে ফেলে ও নীলবীজ নদীতে নিক্ষেপ করে। এতে নীলকরদের কুঠিয়ালরা শক্ত অবস্থানে চলে যায়। তারা পুলিশের সাহায্যে হাজার হাজার কৃষককে গ্রেফতার করে, তাঁদের বাড়িঘর ক্রোক করে নেয়, ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে এবং শত শত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎকাল ধরে তাঁদের ওপর অত্যাচার চালান হয়। আর এটাই ছিল নীলকরদের বড় ভুল। এই অত্যাচারে কৃষক শ্রেণী ফুঁসে ওঠে, এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে শীতের মধ্যভাগ থেকে শুরু হয় নীলকরদের ওপর সশস্ত্র পাল্টা আক্রমণ(৪৩)।
কতগুলো আলোচিত ঘটনার বর্ণনা দেয়া হল:

পিয়ারি সুন্দরী: বাংলার জোয়ান অব আর্ক
টমাস আইভান কেনি তৎকালীন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে সবচে বড় নীল কারবারের অধিকারি ছিল। কেনি ছিল অত্যন্ত জুলুমবাজ, হত্যা-ধর্ষণ এগুলো তার কাছে সামান্য ব্যাপার ছিল। তার কয়েকটি কুঠি ছিল আমলা সদরপুরের পিয়ারি সুন্দরীর জমিদারির ভেতরে। তার বিরুদ্ধে ১৮৫০ সালে রায়েতগন বিদ্রোহ করে। কিন্তু কেনি শক্তহাতে তা দমন করে এবং সকল রায়েতকে উচ্ছেদ করে নতুন রায়েত বসায়। পিয়ারি এতে অসন্তুষ্ট হন। তিনি কেনিকে প্রজাদের উচ্ছেদ করার কাজে নিষেধ করেন। এতে কেনি তাঁকে গালিগালাজ করে এবং জমিদারি কেড়ে নেবার ভয় দেখায়। পিয়ারি অনন্যোপায় হয়ে মৌনব্রত পালন করেন। কিন্তু ১৮৬০ সালে ওই উচ্ছেদকৃত রায়েতগন সংগঠিত হয়ে ফিরে আসে এবং পিয়ারি সুন্দরী তাঁদের সাথে যোগ দেন। ওই বছরই এপ্রিল মাসে তারা কেনিকে হত্যা এবং তার কুঠি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে কুঠিতে হামলা করেন। কেনি বেঁচে যায়, কিন্তু তার কারবার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই হামলা করার কারণে পিয়ারি সুন্দরী ও তার রায়েতদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা করা হয়। পিয়ারি সুন্দরী সকল মামলার ব্যয়ভার নিজে বহন করেন, এতে তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে যান। তার পক্ষের প্রজাদের দ্বীপান্তর, জেল, জরিমানা হয় ও পিয়ারি সহ সকলের ভূসম্পত্তি বাতিল করা হয়। পিয়ারি তার পাঁচ বছর পর যশোরের এক মুচির বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় পরিজনহীন অবস্থায় টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। 
পিয়ারির কথা আমরা ভুলে গেছি, কিন্তু কেনিকে আমরা ভুলিনি। কুষ্টিয়ার কেনি রোডের নামকরন এই নরপশুর নামে করা(৪৪)।

শ্রেণী সংগ্রামের যোদ্ধাঃ বিশে ডাকাত
ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে, এবং সম্ভবত সর্বপ্রথম, ১৮০১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে স্যামুয়েল ফেডির নীলকুঠি লুণ্ঠন করেন বিশ্বনাথ সরদার ওরফে বিশে ডাকাত। বিশ্বনাথ জাতিতে ডোম বা বাগদী ছিলেন। তিনি তিতুমিরের হামকল বাহিনীতে কিশোর বয়সে যোগ দেন। পাঁচ বছর প্রশিক্ষনের পরে তিনি নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামের একদল যুবককে তিনি নীলকুঠি দখল ও ধ্বংসের প্রশিক্ষণ দেন এবং নদীয়া জেলার কুনিয়ার জঙ্গলে ঘাঁটি স্থাপন করেন। সেখানে তার সাথে কাহাররা ও অন্যান্য ডাকাতের দল যোগ দেয়। তিনি নদীয়ার আশেপাশের বহু নীলকুঠি ও নীলের কারবার ধ্বংস করে দেন। তার এরূপ কর্মকান্ডে জেলা প্রশাসক ইলিয়ট এবং নীলকর ফেডি ভীত হয়ে পড়েন। সরকার ও নীলকরেরা তার নাম তৎকালিন ব্রিটিশ ওয়ান্টেড লিস্টে 'বিশে ডাকাত' হিসেবে উঠায়। বিশ্বনাথের মাথার জন্য হাজার টাকা পুরস্কার করা হয়।
১৮০৭ সালে, দীপাবলির রাতে বিশ্বনাথ কুঠিয়াল ফেডির বাসভবন ও কুঠি আক্রমণ করেন। ফেডির দলের প্রায় সবাই এই অকস্মাৎ আক্রমনে মৃত্যুবরণ করে বা পালায়। বিশ্বনাথের প্রধান সেনাপতি মেঘাই সরকার ফেডিকে বন্দি করে বাগদেবী খালের তীরে নিয়ে আসে। ফেডি বিশ্বনাথের কাছে প্রাণভিক্ষা চায়, এবং যিশুর নামে প্রতিজ্ঞা করে যে সে ব্যবসা উঠিয়ে ব্রিটেনে চলে যাবে। বিশ্বনাথ তাঁকে ছেড়ে দেন। ফেডি ছাড়া পেয়ে সেদিন দুপুরেই বিশ্বনাথকে ধরিয়ে দেয়। বিশ্বনাথ দিনাজপুর জেলে আটক হন। কিন্তু বিশ্বনাথ ১৮০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জেল থেকে পালান এবং পালানোর চারদিন পর তিনি আবার ফেডির ঘরে হানা দেন। তার কোষাগার লুণ্ঠন করে ও তার পাইক বাহিনীকে শেষ করে দিয়ে বিশ্বনাথ আবার ফেডির সামনে হাজির হন। কিন্তু এবারো ফেডি নীলচাষ তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দেন এবং বিশ্বনাথের ইষ্টদেবতার দোহাই দিয়ে ক্ষমা চান। বিশ্বনাথ এবারো তাঁকে খুন না করেই পালিয়ে আসেন।
ফেডি এবার বিশ্বনাথের ধ্বংসের জন্য উঠেপড়ে লাগে। সরকারের কাছে আবেদন করে সে সেনাপতি ব্ল্যাকওয়ার ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি দলকে বিশ্বনাথের খোঁজে লাগায়। শুরু হয় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম ম্যানহান্ট। তারা বিশ্বনাথের পালক পুত্র পঞ্চাননকে ধরতে সক্ষম হন। পঞ্চানন পুরস্কারের লোভে বিশ্বনাথের ঘাঁটির কথা ফাঁস করে দেয়। পরের দিন ব্ল্যাকওয়ারের সেনাবাহিনি কুনিয়ার জঙ্গল ঘিরে ফেলে, অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্বনাথ তার অনুচরদের বাঁচাতে নিজে ধরা দেন ও সমস্ত কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিজের ওপরে নিয়ে নেন। ফেডির মুখোমুখি হয়ে বিশ্বনাথ বলেন, 'গোরা সাহেব, আমি তোমার জুলুম থামিয়ে দিয়ে সংসারজীবনে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। তুমি বাধ সাধলে। কিন্তু মনে রেখ, যে জীবন তুমি ভোগ করছ, তা আমার দান। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।'(৪৫)
গঙ্গার তীরভূমিতে বিশ্বনাথকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তার মৃতদেহ সবাইকে দেখানোর উদ্দেশ্যে লোহার খাঁচায় ঢুকিয়ে একটা অশ্বত্থ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়(৪৫)।

নীলকর শিবনাথঃ নায়ক, না খলনায়ক?
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সৈনিক রেনি খুলনা জেলার ইলাইপুর তালুক পত্তনি নিয়ে নীলের কারবার শুরু করেন। রেনি তার ভয়ঙ্কর অত্যাচারের কারণে কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। তার পেয়াদা বাহিনির ভয়ে কুঠির সামনে দিয়ে দিনের বেলায়ও লোক চলাচল করত না। খুলনায় এমন প্রবাদও প্রচলিত ছিল,
শ্বশুর বাড়ি যাবার আগে
রেনি সায়েবের গাঁতা পাবে,
খড় কাটিতে হবে মাঠে
জাল হাতে দাঁড়াও ঘাটে।

রেনি পথচারীদের ধরে কুঠির কাজ করিয়ে নিত, আর এই 'কাজ করিয়ে নেবার' সময়কাল কখনও কখনও সাত-আট দিন স্থায়ী হত। রেনির কুঠির পাশে আরেক নব্য দেশি নীলকর শিবনাথ কুঠি স্থাপন করেন। ইনিও একজন অত্যাচারী নীলকর ছিলেন। রেনি পাইক পেয়াদা বাহিনী পাঠিয়ে দেন শিবনাথের কুঠি পুড়িয়ে দিতে। শিবনাথ তার নিজের পাইকদের নিয়ে সে আক্রমণ প্রতিহত করেন। শুরু হয় দুপক্ষের মাঝে মারামারি। রেনির পক্ষে ছিল প্রাক্তন 'গোরা' সৈনিক এবং দেশি পেয়াদা নিয়ে পাঁচ হাজারের বেশি যোদ্ধা নিয়ে গঠিত বাহিনী। আর শিবনাথকে মানুষ প্রথমে সমর্থন করেনি, কিন্তু সময়ের সাথে মন্দের ভাল হিসেবে তাকেই মানুষ সমর্থন করা শুরু করে। তার পক্ষে আসে বিখ্যাত সব লাঠিয়াল- সরদার সাদেক মোল্লা, গহরতুল্লাহ, খান মাহমুদ, ফকির মাহমুদ, আফাজুদ্দিন, তিলকের রামচন্দ্র মিত্র, বাহিরদিয়ার চন্দ্রকান্ত দত্ত, পানিঘাটের ভৈরবচন্দ্র মিত্র ও গৌরচন্দ্র ধোপা ইত্যাদি। সাধারণ চাষি ও সহায়-সম্বলহীন কৃষকেরা তাঁকে সমর্থন করতে থাকে। শিবনাথ ও রেনির মাঝে খণ্ডযুদ্ধ লেগেই থাকত। তাঁদের যুদ্ধ নিয়ে জারিগানও গাওয়া হয়-
চন্দ্র দত্ত রণে মত্ত, শিব সেনাপতি
গহরতুল্লাহ গেলে গোলা, ছুঁড়ে মারে হাতি।
সাদেক মোল্লা লাঠিয়ে গোলা রেনির দর্প করলে চুর
বাজিল শিবনাথের ডঙ্কা ধন্য বাঙালি বাহাদুর।
খান মাহমুদ সরকি চালে যেন কামানের গুলি
দিশেহারা রেনির গোরা চক্ষুভরা ধূলি।

দুই প্রতিপক্ষের কুঠিই বারবার লুণ্ঠিত হয়, কুঠি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। রাতের বেলা রেনি শিবনাথের কুঠির গোলা ও নীলগুদাম ধ্বংস করে দিল তো পরের দিন সকালেই শিবনাথ রেনির নীলবোঝাই নৌকাবহর ডুবিয়ে দিল। এদের মারামারি থামাতে সরকার নয়াবাদ থানা ও খুলনা মহকুমা স্থাপন করে, সরকারি সেনার সংখ্যা বৃদ্ধি করে। কিন্তু দুই দলের দাঙ্গাবাজি ও লাঠিবাজির মাঝে পড়ে সরকারি বাহিনী দুই মাসও টিকতে পারেনি। ১৮৫৫ সালে শিবনাথের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে। শিবনাথ মারা যাবার পর তার বাহিনী শেষ মরণকামড় দেয়। এই আঘাত রেনির বাহিনী ঠেকাতে পারেনি, তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই নিয়েও প্রবাদ চালু হয় - 'দেখিয়া শিবের ভঙ্গি, পলাইল দীনেশ সিঙ্গি।' আর সেই সাথে নীল চাষও খুলনা থেকে উঠে যায়(৪৭)।

সতী আরতি দেবীঃ সতীর অভিশাপ
সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য ছিলেন নীল চাষের ঘোর বিরোধী এবং এই কারণে সিন্দুরিয়া কুঠির জমিদার ম্যাকনেয়ারের পরম শত্রু। ম্যাকনেয়ার কিছুতেই আচার্যকে বাগে আনতে না পেরে তার পরিবারের ওপর শোধ তুলবার পরিকল্পনা করে। জমিদার পুত্রবধূ আরতি দেবী স্বামী অমরনাথের সাথে জমিদারি নৌকা 'ময়ূরপঙ্খি' করে বাড়ি ফিরছিলেন। অকস্মাৎ ম্যাকনেয়ার তার বাহিনী নিয়ে তাঁদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ম্যাকনেয়ারের বন্দুকের গুলিতে অমরনাথ মারা যান। আরতি দেবীকে ম্যাকনেয়ার ধর্ষণ করে; তার নাক, কান ও স্তন কেটে নেয়। এই ঘটনার পর মথুরানাথ সর্বসমক্ষে বিপ্লবীদের সাথে একাত্মতাবোধ প্রকাশ করেন ও সরাসরি নীলচাষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার সাথে রইস খান, জমিদার শ্রীহরি রায় সহ আরও অনেকে যোগ দেন। ছয় মাস পরে, তারা একজোট হয়ে ম্যাকনেয়ারের কুঠিতে হামলা চালান। ম্যাকনেয়ার পালিয়ে যায়, কিন্তু কুঠিতে তার একমাত্র মেয়ে ইভা আগুনে পুড়ে মারা যায়। বারো দিন পরে, বিপ্লবী দল ম্যাকনেয়ারকে ধরতে সক্ষম হয়। মথুরানাথ ম্যাকের ঘাড়ে গুলি করেন। গুরুতর আহত ম্যাক মথুরানাথের সেই 'ময়ূরপঙ্খি' নৌকায় উঠে পালাতে চেষ্টা করে। মথুরানাথের আদেশে নৌকাসহ ম্যাকনেয়ারকে পুড়িয়ে মারা হয়(৪৮)।

এরকম হাজার হাজার ঘটনা পুরো বাংলা জুড়েই ঘটতে থাকে। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন পিটার গ্রান্ট লেখেন,
'শত সহস্র মানুষের বিক্ষোভের এই প্রকাশ যা আমরা বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করছি, তাঁকে কেবল একটা রং সংক্রান্ত অতি সাধারণ বাণিজ্য-প্রশ্ন না ভেবে গভীরতম সমস্যা বলেই ভাবা উচিৎ। যারা এটি করতে ব্যর্থ, তারা সময়ের ইঙ্গিত ধরতে পারছেন না বলে আমার ধারণা।'(৪৯)

ব্রিটিশ জমিদার ও বণিক সমিতির সভাপতি ম্যাকিন্টশ ১৮৬০ সালের জুলাই মাসে ভারত সচিব চার্লস উডকে এক চিঠিতে লেখেন,
'গ্রামাঞ্চলে অবস্থা বর্তমানে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল। কৃষকেরা তাঁদের ঋণ ও চুক্তিপত্র অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, মহাজন ও মালিক ইংরেজদেরকে দেশ থেকে বিতাড়ন করে হৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধার এবং সকল ঋণ রদ করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।'(৫০)

বড়লাট লর্ড ক্যানিং নীল বিদ্রোহের দুই মাস পরে ইংল্যান্ডে চিঠি লিখেন,
'নীল চাষিদের বর্তমান বিদ্রোহের ব্যাপারে প্রায় এক সপ্তাহকাল আমার এতই উৎকণ্ঠা হয়েছিল যে, দিল্লির ঘটনার (১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ) সময়ও আমি এতটা চিন্তিত হই নি। আমি সব সময় চিন্তা করেছি যে যদি কোন নির্বোধ নীলকর ভয়ে বা ক্রোধে একটি গুলিও ছোঁড়ে, তাহলে সেই মুহূর্তেই দক্ষিনবঙ্গের সমস্ত কুঠিতে আগুন জ্বলে উঠবে।'(৫১)

নিজেরা রক্ষা পেতে নীলকরেরা ১৮৬০ সালের মার্চ মাসে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে স্মারকপত্র দেয়। সেখানে তারা জানায়,
'কৃষককুল সংগঠিতভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। তাঁদের দিয়ে আর নীলের আবাদ করান সম্ভবপর হচ্ছে না। আদালতে কোন মামলা দায়ের করা যাচ্ছে না, কারণ আমাদের অভিযোগ প্রমাণের জন্য কোন সাক্ষি পাওয়া যাবে না। এমনকি আমাদের কর্মচারীরাও আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে সাহস পাচ্ছে না......রায়েতরা বর্তমানে খুবই মারমুখি। তারা ভয়ঙ্করভাবে খেপে গেছে। তারা বর্বরের মত যেকোনো দুষ্কার্য করতে এখন প্রস্তুত। প্রতিদিন তারা আমাদের কুঠি এবং বীজের গোলায় আগুন দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের প্রায় সকল কর্মচারী ও চাকরেরা কুঠি ত্যাগ করে চলে গেছে। কারণ প্রজারা তাঁদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া বা খুন করার ভয় দেখাচ্ছে। যে দুই একজন আছে, তারাও খুব শীঘ্র চলে যেতে বাধ্য হবে। কারণ পার্শ্ববর্তী বাজারেও তারা খাদ্যদ্রব্য কিনতে যেতে পারছে না। সকল জেলাতেই বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে।'(৫২)

নীলচাষের অন্তিমকালঃ ইন্ডিগো কমিশন গঠন:

১৮৬০ সালের ৩১ মার্চ নীল কমিশন বা ইন্ডিগো কমিশন গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন বঙ্গীয় সরকারের সেক্রেটারি M.W.S. Seaton Carr। কমিশনের একজন বাদে সবাই ছিলেন ইংরেজ। বাকি ওই একজন ছিলেন জমিদার সমিতির এক সদস্য। কমিশনের প্রথম অধিবেশন বসে ১৮৬০ সালের ১৮ মে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরে। কমিশন তিন মাসে ১৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। সাক্ষীদের মাঝে ১৫ জন সরকারি কর্মচারী, ২১ জন নীলকর, ৮ জন মিশনারি, ১৩ জন জমিদার ও ৭৯ জন নীলচাষি(৫৩)। দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে কমিশন রিপোর্ট দেয়, 'The whole system is vicious in theory, injurious in practice and radically unsound.'(৫৪)

কমিশনের রিপোর্ট ও ছোটলাটের স্বীকৃতি সত্ত্বেও সরকার রায় দেয় নীলকরদের দিকেই। সরকার নিজেকে নিরপেক্ষ ঘোষণা করে, কিন্তু নীলকরদের নিরাপত্তার জন্য পূর্বের সকল দমনমূলক আইন বজায় রাখা হয়; নতুন নতুন থানা ও মহকুমা স্থাপন করে পুলিশের শক্তি বাড়ানো হয়, যাতে সহজে বিদ্রোহ দমন করা যায়(৫৫)। সেই সাথে কৃষকদের সান্ত্বনা দিতে কয়েকটি অর্থহীন ইশতেহার জারি করা হয়-
১. সরকার নীলচাষ করার বিষয়ে নিরপেক্ষ।
২. আইন অমান্য করলে বিদ্রোহী প্রজা বা নীলকর কেউই শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবে না।
৩. অন্য শস্যের মত নীল চাষ করা বা না করা প্রজার ইচ্ছাধীন।

সরকারের এ প্রতারণা কৃষকেরা বুঝতে পারে। নদীয়া ও যশোরের কৃষকেরা হেমন্তকালীন নীলচাষ করা এবং জমিদার ও নীলকরদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ধ্বংসাত্মক কর্মতৎপরতা থামাতে সরকার দুই জেলায় দুই দল সৈন্য রণতরী যোগে পাঠায়। দুই দলের অধিনায়কদের সাথে কৃষক জনতা আলোচনায় বসে। প্রজারা বলে, 'খাজনা দিতে আপত্তি নেই, তবে নীলকর ও জমিদারদের নির্যাতন হতে প্রজাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে(৫৬)'। অধিনায়ক দুজন ফিরে গিয়ে এই বিষয়ে রিপোর্ট দাখিল করেন।

রিপোর্ট পেয়ে বাংলার ছোটলাট গ্রান্ট স্বচক্ষে অবস্থা দেখতে স্টিমারে করে গোপনে ১৮৬০ সালের অগাস্ট মাসে ৭০ মাইল দীর্ঘ জলপথ পরিভ্রমণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু যাত্রা শুরুর পর কোনভাবে প্রজারা জেনে ফেলে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ স্টিমার তীরে ভেড়াবার জন্য নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁদের হাতে ঝাঁকিজাল ও কোঁচ। গ্রান্ট ভীত-সন্ত্রন্ত হয়ে নদীর মাঝ দিয়ে স্টিমার চালাবার আদেশ দেন। কিন্তু পথ কোথায়? নদী মানুষে মানুষে পরিপূর্ণ। গ্রান্ট ভয় পেয়ে যান। কিন্তু জনতা তাঁকে অভয় দেয়, তিনি অতিথি, তার জীবনের কোন ভয় নাই। স্টিমার তীরে ভেড়ান হল। গ্রান্ট সবাইকে পাবনা যেতে বললেন। বললেন, সেখানে জনসভায় তিনি নীল চাষ তুলে দেবার ঘোষণা দেবেন। এবারে স্টিমার চলল পাবনা। জন পিটার গ্রান্ট নিজেই এ অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। বলেছেন, প্রায় ১৪ ঘণ্টা ধরে ৬০-৭০ মাইল পথ ভ্রমণকালে তিনি নদীর উভয় পার্শ্বে লক্ষ লক্ষ জনতার ভিড় দেখেছেন। এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আর কোন রাজকর্মচারীর হয়নি(৫৭)।

পাবনায় গিয়ে জনসভায় গ্রান্ট বলেন, 'অতি শীঘ্রই নীল চাষ বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চাষির ইচ্ছা ব্যতীত, কাউকে জোর করে নীল চাষ করান যাবে না। কেউ জোর করে নীল চাষ করালে আইন কঠোর হাতে তাঁকে দমন করবে'। কিন্তু গ্রান্ট তার কথা রাখতে পারেননি। নীলকররা তাঁদের সমিতি Indigo Planters Association এর ক্ষমতার জোর খাটিয়ে নীল চাষ বন্ধের যে আইন প্রণীত হবার কথা ছিল, তা রদ করে দেয়। এমনকি নীলকর সমিতি তাঁকে কঠোর অবস্থানের জন্য গালাগালি করতে থাকে। বিক্ষুব্ধ গ্রান্ট বিবৃতি দেন, 'আইনের বিপক্ষে, নীলচাষের সপক্ষে পৃথিবীর কোন শক্তিই আর বেশিদিন এ ব্যবস্থাকে সমর্থন করতে পারবে না। ন্যায়ের পথ উপেক্ষা করে যদি সরকার চলতে থাকে, তবে আরও বিপুল কৃষক অভ্যুত্থান ও বিপ্লব সরকারের শাস্তি বিধান করবে। সেই অভ্যুত্থান ভারতে ইউরোপীয় ও অন্যান্য মূলধনের পক্ষে যে সাংঘাতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে তা সাধারণ মানুষের হিসাবের বাইরে।'(৫৮)

ভারতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম পরবর্তীতে লিখেছিলেন, 'বিভিন্ন তথ্য থেকে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমরা ভয়ঙ্কর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি...আমাকে বিভিন্ন জেলা-মহকুমার রিপোর্ট দেখানো হয়, সেগুলোতে বারবার বিপ্লবের কথা, দরিদ্র মানুষের কথা এসেছে...তারা নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে যে, অত্যাচারে-অনাচারে তাঁদের মৃত্যু অনিবার্য। মরবার পূর্বে তাই তারা একটা কিছু করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।...এ একটা কিছুর অর্থ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। এই অবস্থা চলতে থাকলে একটা ব্যাপক অভ্যুত্থান শুরু হবে, এবং সেটা কৃষকদের মাঝে থেমে থাকবে না(৫৯)।'

এদের কথা সত্যি হয়ে দেখা দেয় ক'বছরের মাঝেই। যারা জুলুমবাজ নীলকর ছিল, বিপ্লবের মুখে তারা ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়, নইলে কৃষকদের সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারায়। শুধুমাত্র যারা প্রজাদের সাথে সদয় ব্যবহার করতে শিখেছিল, তাঁদের কুঠিই টিকে থাকে। এসব কুঠিয়াল টিকে থাকার জন্য নানা জনহিতকর কাজ করতে শুরু করে। নতুন রাস্তাঘাট করে দেয়, মজা পুকুর সংস্কার করতে সাহায্য করে। নতুন মন্দির বানিয়ে দেয়। আবার এদের মাঝে ব্যতিক্রম ছিল সিন্দুরিয়া কুঠির ম্যানেজার ড্যাম্বেল পিটারস। সে এই বিদ্রোহে খেপে গিয়ে আরও বেশি অত্যাচার চালাতে শুরু করে। ওই স্থানে পুলিশের সংখ্যা বেশি ছিল বলে কৃষকদের প্রতিবাদ করতে গেলেই বিপদে পড়তে হত। এরই ফল হিসাবে ১৮৮৯ সালে সিন্দুরিয়ায় সর্বশেষ নীল বিদ্রোহ হয়। ফলস্বরূপ নীল চাষ সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে যায়। এই বিদ্রোহে সর্বপ্রথম অভিজাত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কৃষকদের সমর্থন করেন।
সিন্দুরিয়ার বিদ্রোহ ছিল সর্বশেষ নীল বিদ্রোহ। এর পরে বাংলায় আর বিদ্রোহ হয়নি, করার দরকারও হয়নি। কারণ কৃষকদের এমন বিদ্রোহে প্রাণ বাজি রেখে নীল চাষ করতে নীলকররা আর আগ্রহী হতে পারেনি। তাছাড়া জার্মানিতে কৃত্রিম রং আবিষ্কৃত হয়, এতে নীলকরদের লাভ পঞ্চাশ ভাগ কমে যায়। ফলে সব মিলিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, যাতে নীল চাষ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলার কৃষক মুক্তি পায় ঘৃণ্য নীলকরদের হাত থেকে।

নীল বিদ্রোহের সাফল্যের পেছনে কারণ তিনটি। 
প্রথমতঃ, নীল বিদ্রোহের সম্পূর্ণ উৎপত্তি কৃষক অর্থাৎ উৎপাদক শ্রেণীর হাতে। এই বিদ্রোহে গ্রাম সমবায় আরও মহৎ হয়ে শ্রেণী সমবায়ে পরিণত হয়। একজন নেতা হারালে আক্ষরিক অর্থেই একশ জন এসে সে খালি স্থান পূরণে সক্ষম ছিল। সুতরাং নেতৃত্ব পরিচালনায় কখনো ছেদ পড়ে নি।
দ্বিতীয়তঃ, তখন নব্বই শতাংশ লোক কৃষিকাজ করত। এরা যেকোনো বিদ্রোহের বেস হিসেবে কাজ করে। বেস-ই যখন বিদ্রোহ করে, সে বিদ্রোহ থামানোর সাধ্য কার?
তৃতীয়তঃ, কৃষকদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে কোন বিভ্রান্তি ছিল না। রুখে দাঁড়াতে হবে, নইলে না খেয়ে মরব - এতটাই সরল ছিল তাঁদের ভাবনা।

আর এই কারনেই বাংলার সর্বপ্রথম সফল বিদ্রোহ - নীল বিদ্রোহ।

টীকা
১. মাধ্যমিক সামাজিক বিজ্ঞান (শিক্ষাবর্ষ ২০১০), পৃঃ ৪৭-৪৮
২. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৯৩
৩. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ১৭
৪. C.E. Buckland: Bengal under the Lieutenant Governors
৫. Major Smith: Report on the Maldah
৬. শ ম শওকত আলিঃ কুষ্টিয়ার ইতিহাস
৭. সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
৮. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ১৯
৯. সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
১০. W.W. Hunter: Imperial Gazetteer of India
১১. প্রমোদ সেনগুপ্তঃ নীল বিদ্রোহ ও বাঙ্গালি সমাজ
১২. তৎকালীন সময়ে কোন জমিতে যদি তাগিদগীর প্রায় একহাত লম্বা একটি খুঁটি গেড়ে তার মাথায় দড়ি বেঁধে দিত, তাহলে কৃষক বুঝতে পারত যে এই জমিতে নীল চাষ করতে হবে। এটাই 'দাগ মারা'।
১৩. যার জন্য পেয়াদার নামের সাথে ব্যঙ্গার্থে 'সম্বুন্ধি' শব্দটি যোগ করা হত এবং তখন থেকে এটি গালি হিসেবে প্রচলিত হয়।
১৪. এজন্য সমাজে তাদের নাম বিকৃতভাবে ধরা হত - রামা ভেড়ি, জমরে মাহুত, আহাদে মালি, বিশে মুর্গি, স্যাকরা বরকন্দাজ, হরে পেয়াদা ইত্যাদি।
১৫. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'ভুলে যাওয়া নীলঃ রক্তে রাঙ্গানো বিপ্লব', পৃঃ ২৯
১৬. ব্রিটিশ সরকার এই ভূস্বামীদের এক থেকে সাতটি খুন করার অধিকার পর্যন্ত দিয়েছিল। এই বিষয় থেকেই 'সাতখুন মাপ' কথার উৎপত্তি।
১৭. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ২৪
১৮. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'ভুলে যাওয়া নীলঃ রক্তে রাঙ্গানো বিপ্লব', পৃঃ ৪২
১৯. বারুই পাড়া থেকে এত বেশি নীল রপ্তানি হত যে এর নাম পরিবর্তিত হয়ে নতুন নাম হয় নীলগঞ্জ।
২০. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ২৫
২১. তাজুল ইসলামঃ 'চুয়াডাঙ্গার করুণ কথা'
২২. সিন্দুরিয়া কুঠি স্থাপনের জন্য মে সাহেব প্রথমে মরতুজাপুর গ্রামের কাছে পাঁচপীরতলায় আসেন। সেখানে এক বিরাট শ্যাওড়া গাছ ছিল। তার সংলগ্ন দুইটি উঁচু ঢিবি-ও ছিল। কিংবদন্তিতে আছে, এই স্থানে কুতুব উদ্দিন শাহ এবং হজরত অলি নেয়ামত শাহ নামক দুই ইসলাম প্রচারক বুজুর্গের সমাধি ছিল এবং আরেক বিখ্যাত পীর ওলি দেওয়ান শাহ এখানেই শিক্ষা প্রদান করতেন। মে সাহেব সে গাছ কেটে কুঠি বানানোর সিদ্ধান্ত নিলে গ্রামবাসী তার প্রতিবাদ করে এবং সকল কুলি মজুর কাজে অনীহা জানায়। এমনকি সাহেবের প্রধান কাঠুরিয়া কালিচরণ সরকার সরদার বাগদীও সরাসরি হুকুম অমান্য করে। এতে সাহেবের পুত্র, টমাস আইজ্যাক মে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেই কুঠার হাতে সরাসরি গাছের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্ত মাত্রের ঘটনা! উত্তেজনা কাটতেই দেখা গেল তার কুঠারাঘাত গাছে না লেগে তার তলপেটের বাম পাশ ভেদ করে গেছে! কলকাতায় নিয়ে যাবার পথে তার মৃত্যু হয়। মে সাহেব পরের সপ্তাহেই বাংলাদেশ ত্যাগ করেন।
২৩. রিভস সেই শ্যাওড়া গাছ এবং তার সংলগ্ন উঁচু ঢিবি বাইরে রেখে নতুন দালানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু এবার নতুন উৎপাত শুরু হয়। সারাদিন সে দেয়াল এবং দালান স্থাপিত হত, রাতে কে বা কারা এসে তা নিকটাবর্তী নবগঙ্গার জলে নিক্ষেপ করত। প্রথমে পাহারাদার এবং পরে হিন্দু পেয়াদা রেখেও এই ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে রিভস তার অংশীদারদের পরামর্শে এখানকার অর্ধনির্মিত কুঠি ত্যাগ করে দোলাই খালের একাংশ মাটি ভর্তি করে সেখানে কুঠি নির্মাণ করেন।
২৪. ইঞ্জিনিয়ার মিঃ বোরিক কুঠির নির্মাণকালে এখানে তাবু খাটিয়ে বাস করতেন বলে স্থানটি আজ অবধি 'বোরিক পোল' নামে অভিহিত।
২৫. সিন্দুরিয়া নীলকুঠির সচিবালয় বাংলাদেশের মাঝে সর্ববৃহৎ ছিল।
২৬. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৩১
২৭. কথিত আছে, ম্যাকনেয়ার সারাদিন যাদের ওপর অত্যাচার চালাতেন, তাঁদেরকে রাতে নাচমহলে ডেকে সারারাত ভাল ভাল খাবার খাওয়াতেন, আপ্যায়ন করতেন। বেচারা কৃষক খুশি হত, ভাবত সাহেব আর মারবেন না। কিন্তু সকাল হলেই কাছারি ঘরে ডেকে আবার তার ওপর অত্যাচার শুরু হয়ে যেত।
২৮. Calcutta review. Vol. 36, p. 40
২৯. James Watts: Dictionary of Economy Products of India.
৩০. প্রমোদ সেনগুপ্তঃ নীল বিদ্রোহ ও বাঙ্গালি সমাজ
৩১. Indigo Comission Report, Evidence, p. 32
৩২. সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
৩৩. নীল কমিশনের সামনে তারাচাঁদ মণ্ডলের স্বীকারোক্তি
৩৪. Calcutta Review, Nov. 1860
৩৫. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৪৮
৩৬. দুর্গাপুরের পিয়ারি মণ্ডল অত্যন্ত রসিক লোক ছিলেন। তিনি নীলবীজ বাড়িতে এনে বপন না করে নষ্ট করে ফেলেন। কুঠিয়াল তাঁকে তলব করে এর কারণ জানতে চায়। তিনি উত্তর দেন, 'হুজুর, ভুলক্রমে ছেলেপিলে নীলবীজকে তিল ভেবে ভেজে খেয়ে ফেলেছে। এবারের মত মাফ চাই।' কুঠিয়াল তার কথা শুনে আবার তাঁকে নীলবীজ দেন। এবারে তিনি বীজগুলো ভেজে তারপর বপন করেন, যাতে নীলের উৎপাদন না হয়। তার এই পদ্ধতি অবলম্বন করে হাজার হাজার বিঘার নীল আবাদ নষ্ট করে ফেলে।
৩৭. কুঠির প্রজাদেরকে দুই আনা বৃদ্ধি করে কবুলিয়াতি দেয়ার আদেশ করা হয়। প্রজারা প্রতিবাদ করলে শীতল বিশ্বাস উৎপীড়ন শুরু করে। প্রজারা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তার কাছারিঘর লুটপাট ও ভস্মীভূত করে এবং নিকটাবর্তী বিলের কাছে তাঁকে ঘেরাও করে। তর্ক বিতর্কের সময় প্রজাদের একজন বলে, নাক কান কেটে দাও, হত্যা কর না। এই কথা শুনে গোমস্তা রেগে গিয়ে বলে, 'নাক-কান কেটে দিয়ে ভিটেয় ঘুঘু চড়িয়ে দোব।' ফলে উত্তেজিত জনতা তাঁকে সেখানেই হত্যা করে বিলের পাড়ে পুঁতে রাখে।
৩৮. ঘোলদাড়ি গ্রামের কৃষক রব্বানি চুক্তিপত্রে কখনো টিপসই দেননি। কুঠিয়াল ব্রুমফিল্ড তাঁকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেন, এমনকি এক পর্যায়ে রব্বানির বামহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ নেবার জন্য আঙ্গুলটি কেটে নেয়। তবু তিনি হার মানেন নি, বরঞ্চ পালিয়ে গিয়ে বিদ্রোহী বাহিনিতে যোগ দেন।
৩৯. Indian Field, April, 1860
৪০. Hindu Patriot, February, 1860
৪১. অনাথনাথ বসুঃ 'মহাত্মা শিশিরকুমার'
৪২. সতীশচন্দ্র মিত্রঃ 'যশোর খুলনার ইতিহাস'
৪৩. সুপ্রকাশ রায়ঃ প্রাগূক্ত
৪৪. শ.ম. শওকত আলিঃ প্রাগূক্ত
৪৫. শ্রী মোহিত রায়ঃ কুখ্যাত ডাকাত বিশ্বনাথ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩/১০/৬১
৪৬. শ্রী বিমলেন্দু করনিঃ 'বিশে ডাকাত' প্রবন্ধ
৪৭. শ. ম. শওকত আলিঃ প্রাগূক্ত
৪৮. যোগেশচন্দ্র বাগলঃ Peasant revolution in Bengal.
৪৯. Parliamentary Papers, Vol.45, p. 75
৫০. Hindu Patriot, August, 1860
৫১. Buckland: Bengal under the Lt. Governors
৫২. Hindu Patriot: 17th march, 1860
৫৩. Indigo Comission Report, Evidence, p. 13
৫৪. Indigo Comission Report, Evidence, p. 03
৫৫. শ.ম. শওকত আলিঃ প্রাগূক্ত
৫৬. এম. এ. বারিঃ চুয়াডাঙ্গা গ্যাজেটিয়ার
৫৭. Buckland: Bengal under the Lt. Governors, Vol.1, p. 96
৫৮. Parliamentary Papers, Vol. 45, p. 96
৫৯. Sir William Wedderburn: Allan Octovian Hume, Father of Indian National Congress

মূল লেখা: প্রোফেসর শঙ্কু, লিংক http://www.somewhereinblog.net/blog/professorShonku/29821728 

২ এপ্রিল, ২০১৩

জামাত নিষিদ্ধ হলে লাভ বিএনপির!! ক্ষতি আওয়ামী লীগের!!!


জামাতকে নিষিদ্ধ করা সরকারের ১ ঘন্টারও কাজ না। কিন্তু আওয়ামি লীগ জামাতকে নিষিদ্ধ করতে কালক্ষেপন করছে। কারন, নিষিদ্ধ করলে জামাতের সমর্থকরা বিএনপিতে চলে আসবে। এখন যেসব হরতাল হয়, তাতে যারা পিকেটিং করছে তাদের অধিকাংশই জামাতের কর্মী। আর জামাত - বিএনপি জোট ভাঙ্গতে পারলে বিএনপির আন্দোলন করার শক্তিই থাকবে না। বিএনপি রাজনৈতিক ভাবে বিকলাঙ্গ হবে ও আওয়ামী লীগ একক প্রধান রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
জামাত কখনোই একা থাকেনা। বিনপি-জামাত জোট ভাঙ্গলেই আমলিগ-জামাত গঠিত হবে। অতিতেও হয়েছে। কিন্তু জামাতকে নিষিদ্ধ করলে এই পরিকল্পনা সফল হবে না, জামাতের সমর্থকরা বিএনপিতে যোগ দেবে।
কোন ভাবে আওয়ামী লীগ সরকার জামাতকে নিষিদ্ধ না করেই বিএনপি ও জামাতকে আলাদা করতে সক্ষম হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ জামাতকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি কে ধংস করার সুযোগ পাবে।
আওয়ামি লীগ বলছে, জামাত থাকলে বিএনপির সাথে আলোচনা হবে না। যদিও তত্যাবধায়ক সরকারের দাবিতে ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ লাগাতার ১ মাস দেশ অচল করে রেখে ছিলো, জামাতের শক্তির সহায়তা নিয়েই করেছিলো!! আর জামাতকে নিষিদ্ধ করা সরকারের ১ ঘন্টারও কাজ না, দরকার শেষ হওয়া মাত্র জামাতকে নিষিদ্ধ করা যাবে। তখন আর বাকশাল লাগবে না, এমনিতেই দেশে একটি মাত্র দল, আওয়ামী লীগ থাকবে।

বাংলাদেশ: সংক্ষেপে ৪০০০ বছরের ইতিহাস।




বাংলা শব্দটি দ্রাবিড়দের বং/বঙ্গা উপজাতি হতে এসেছে
বাংলাদেশের মূল অংশ বঙ্গোপসাগর থেকে জেগে উঠেছে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এর কিছু অংশে মানব বসতির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এবং অতি প্রাচীন কাল থেকেই এখানে একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি বিরাজমান ছিল।

মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবী নূহ :-এর ছয় পুত্র। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে উপনিবেশ গড়ে তোলেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন হিন্দ্। এই হিন্দের নামানুসারে হিন্দুস্তানের নাম। হিন্দ্-এর চার পুত্র। তাদের এক ছিল বাং। বাং-এর সাথে আল্ / বাঁধ শব্দ যুক্ত হয়। যা জল প্লাবনের হাত থেকে জনপদ শস্যক্ষেত রক্ষা করতো।সুলতান সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বঙ্গ শব্দের সাথে সংস্কৃত লাহ্ প্রত্যয় যুক্ত করে, বাংলা শব্দটির সুচনা করেন।
বাংলা শব্দটি এসেছে দ্রাবিড়দের বং/বঙ্গা উপজাতি হতে।
মহাভারত থেকে জানা যায়, রাজা বালির পোষ্য সন্তান ভাঙ্গা নিজের নামে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মহাভারত অনুযায়ী, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র সুহ্ম - এই পাঁচটি পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতারা একই বংশের সন্তান রাজা বলির পুত্র ছিলেন। মহাভারতে পুণ্ড্র বা পৌণ্ড্র ভারতবর্ষের একটি রাজ্য হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। পৌণ্ড্ররাজ্য বৈদিক আচার আচরণের বিরোধী ছিল। তাদের নিজস্ব উন্নত সংস্কৃতি ছিল যা বৈদিক সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।
উয়ারি-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় হাজার বছর আগে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো। দ্রাবিড় তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী সেসময় বসতি স্থাপন করেছিল। পরবর্তীকালে অঞ্চলটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে স্থানীয় বিদেশীদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে।
আর্যরা প্রথমে অনেক চেষ্টা করেও পুর্ব বাংলার অঞ্চল জয় করতে পারেনি। তাই, এই রাজ্যের অধিবাসীদের গালিগালাজ করে শ্লোক তৈরী করেছিলো।
আলেকজান্ডার বিশ্ব জয় করে বাংলার পশ্চিম প্রান্তে গঙ্গার পারে পৌছান তারপর তার জেনারেলরা তখনকার বাংলার(গঙ্গোরিধি) রাজার বিবরন শুনে আর আগানোর সাহস পান নাই। এই বাংলা অঞ্চল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বারা শাষিত হয়েছে। শাষকরা এসেছে, আবার চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমরা রয়ে গেছি। আমাদের সম্পদ বলতে জমি আর আমি(মানবসম্পদ) ব্রিটিশরা যখন বাংলাদেশে আসে, তখন বাংলা ছিলো বিশ্বের ৬ষ্ঠ সমৃদ্ধ অঞ্চল। চেস্টা করলে আবার কেন মাথা উচু করে দাড়াতে পারব না?

২০০০ বিসি(- ৪০০০ বছর) প্রায় চারহাজার বছরের পুরনো তাম্রযুগের ধ্বংসাবশেষ বাংলায় পাওয়া গেছে। গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাকে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল।

ভাষা পরিবার: Indo-European -> * ইন্দো-ইরানীয় -> o ইন্দো-আর্য -> + মাগধী প্রাকৃত -> # অপভ্রংশ অবহট্ঠ -> * বাংলা-অসমীয়া -> o বাংলা।
বাংলা ভাষার ইতিহাস তিন পর্যায়ে বিভক্ত:
প্রাচীন বাংলা (৯০০/১০০০ খ্রিস্টাব্দ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ) — লিখিত নিদর্শনের মধ্যে আছে চর্যাপদ, ভক্তিমূলক গান; আমি, তুমি, ইত্যাদি সর্বনামের আবির্ভাব; ক্রিয়াবিভক্তি -ইলা, -ইবা, ইত্যাদি। ওড়িয়া অসমীয়া এই পর্বে বাংলা থেকে আলাদা হয়ে যায়।
মধ্য বাংলা (১৪০০১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) — সময়কার গুরুত্বপূর্ণ লিখিত নিদর্শন চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন; শব্দের শেষেধ্বনির বিলোপ; যৌগিক ক্রিয়ার প্রচলন; ফার্সি প্রভাব। কোন কোন ভাষাবিদ এই যুগকে আদি অন্ত্য এই দুই ভাগে ভাগ করেন।
আধুনিক বাংলা (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে) — ক্রিয়া সর্বনামের সংক্ষেপন (যেমন তাহারতার; করিয়াছিলকরেছিল)

১০০০ বিসি(- ৩০০০ বছর) ইন্দো-আর্যরা আসার পর অঙ্গ, বঙ্গ এবং মগধ রাজ্য গঠিত হয়। এই রাজ্যগুলি বাংলা এবং বাংলার আশেপাশে স্থাপিত হয়েছিল। যার বর্ণনা প্রথম পাওয়া যায় প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে, অথর্ববেদে

৭০০ বিসি(- ২৭০০ বছর) পুড্রবর্ধন, রাজধানিঃ মহাস্থান-গর (বর্তমান বগুরা)
৬০০ বিসি(- ২৬০০ বছর) অঙ্গ পুন্ড্র রাজ্যের উথথান। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার বেশিরভাগ এলাকাই শক্তিশালী রাজ্য মগধের অংশ ছিল। মগধ ছিল একটি প্রাচীন ইন্দো-আর্য রাজ্য। মগধের কথা রামায়ণ এবং মহাভারতে পাওয়া যায়।


হর্য্যঙ্ক সাম্রাজ্য (৬৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ৪১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
শিশুনাগ সাম্রাজ্য (৪১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
নন্দ সাম্রাজ্য (৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
মৌর্য সাম্রাজ্য (৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
শুঙ্গ সাম্রাজ্য (১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
গুপ্ত সাম্রাজ্য (৩২০ খ্রিস্টাব্দ - ষষ্ঠ শতাব্দী)
মহাভারত পুরান অনুযায়ী, এই বৃহদ্রথই মগধ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তিনি বসু চৈদ্য উপারিচারার পুত্র বৃহদ্রথের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক রামেশ মেনন লিখেছেন, “ভারতবর্ষে বৃহদ্রথের খ্যাতি ছিল পৃথিবীর বুকে পড়া সূর্যের আলোর মতই মগধ সাম্রাজ্যের উত্থানের সময়টুকুকে ঐতিহাসিকরাষোড়শ মহাজনপদের যুগবলে ডাকেন ১৬টি মহাজনপদে বিভক্ত ছিল তখন এখনকার এই ভারতবর্ষঃ
১। কাশী
২। কোশল
৩। অঙ্গ
৪। মগধ
৫। বজ্জি / বৃজিসংঘ (বৈশালী গণরাজ্য)
৬। মল্ল / মালব
৭। চেদী
৮। বংশ বা ৎস
৯। কুরু
১০। পাঞ্চাল
১১। ৎস্য
১২। শুরসেন
১৩। অস্মক
১৪। অবন্তী
১৫। গান্ধার
১৬। কম্বোজ

৫৪৪ বিসি(- ২৫৪৪ বছর)রাঢ়/কলিঙ্গের রাজা সিংহবাহু পুত্র রাজকুমার বিজয় সিংহের লংকা জয় করেন।

বুদ্ধের সময়ে এটি ছিল ভারতের চারটি প্রধান রাজ্যের মধ্যে একটি। মগধের ক্ষমতা বাড়ে বিম্বিসারের (রাজত্বকাল ৫৪৪-৪৯১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) এবং তার ছেলে অজাতশত্রুর (রাজত্বকাল ৪৯১-৪৬০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) আমলে। বিহার এবং বাংলার অধিকাংশ জায়গাই মগধের ভিতরে ছিল।

সিদ্ধাত্থ গোতম বুদ্ধ ছিলেন প্রাচীন ভারতের এক ধর্মগুরু এবং বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর জীবৎকাল ৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে। সিদ্ধার্থের পিতা ছিলেন শাক্য বংশীয়মায়াদেবী। মায়াদেবী কপিলাবস্তু থেকে পিতার রাজ্যে যাবার পথে লুম্বিনি গ্রামে (অধুনা নেপালের অন্তর্গত) সিদ্ধার্থের জন্ম দেন। জ্ঞানান্বেষণে, মাত্র ২৯ বছর বয়সে ঘুমন্ত স্ত্রী, পুত্র, পরিবারকে নিঃশব্দ বিদায় জানিয়ে তিনি প্রাসাদ ত্যাগ করেন। কিছু দিন যাবার পর তিনি মগধের উরুবিল্ব নামক স্থানে গমন করেন। সেখানে পত্রবৃক্ষতলে ভূমিতে পূর্বমুখি হয়ে তপস্যায় বসেন।

ত্রিপিটক বৌদ্ধদের মূল ধর্মীয় গ্রন্থ। খ্রীষ্ট পূর্ব ৩য় শতকে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ত্রিপিটক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসাবে স্বিকৃত হয়। ত্রিপিটক পালি ভাষার গ্রন্থ। আর সংস্কৃত, পালি প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে।

৪৫০ বিসি(- ২৪৫০ বছর) উয়ারী-বটেশ্বর( বর্তমান নরসীনদি) সভ্যতার বিকাশ।

৩২৭ বিসি(- ২৩৩৯ বছর) ৩২৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটে সেনাবাহিনী মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের সীমানার দিকে অগ্রসর হয়। এই সেনাবাহিনী ক্লান্ত ছিল এবং গঙ্গা নদীর কাছাকাছি বিশাল ভারতীয় বাহিনীর মুখোমুখি হতে ভয় পেয়ে যায়। ওই সময় বাংলা গঙ্গা নদীর জন্য গঙ্গোরিধি নামে পরিচিত ছিল। তখন গঙ্গোরিধির রাজার ,০০০ রথ, ,০০০ হাতি, ২০,০০০ ঘোড়া, ,০০,০০০ সৈন্য ছিলো। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সেনাবাহিনী বিয়াসের কাছে বিদ্রোহ ঘোষনা করে এবং আরও পূর্বদিকে যেতে অস্বীকার করে আলেকজান্ডার দি গ্রেট দিন নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখেন কিন্তু তার সেনাপতিরা বাংলা আক্রমনে রাজি হন নাই। আলেকজান্ডার তখন তাঁর সহকারী কইনাস (Coenus) এর সাথে দেখা করার পরে ঠিক করেন ফিরে যাওয়াই ভাল।
গঙ্গোরিধির রাজা অগ্রামেস ছিলেন সাধারন ঘরের মানুষ, যিনি খুবই সুদর্শন বুদ্ধিমান ছিলেন। রানীর সহায়তায় পুর্বের রাজাকে হত্যা করে তিনি রাজা হন, অল্প দিনেই তিনি জনতার মন জয় করেন।

৩২০ বিসি(- ২৩৩২ বছর) মৌর্য সাম্রাজ্য মৌর্য রাজবংশ-শাসিত এই সাম্রাজ্য ৩২১ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। মৌর্য সাম্রাজ্যের ৎসভূমি ছিল গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের মগধ রাজ্য (অধুনা বিহার, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ বাংলা) মৌর্য সাম্রাজ্যের মোট আয়তন ছিল ,০০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এই সাম্রাজ্য ছিল সমসাময়িক বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্যগুলির অন্যতম। সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তার ছিল উত্তরে হিমালয়, পূর্বে বর্তমান অসম, পশ্চিমে বালুচিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব ইরান আফগানিস্তান পর্যন্ত। সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র (অধুনা পাটনা)

৩০০ বিসি(- ২৩১২ বছর) সম্রাট অশোক দ্যা গ্রেট জন্ম ৩০৪ খ্রীষ্টপূর্ব, শাসনকাল ২৯৮-২৭২ খ্রীষ্টপূর্ব; তিনি ছিলেন মৌর্য রাজবংশের রাজা। তার সময়ে মৌর্য সাম্রাজ্য ছিলো এখনকার বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ভারতসহ একদম পাকিস্তান-আফগানিস্তান পর্যন্ত। ভারতের ইতিহাসে দুজন রাজাকে গ্রেট উপাধি দেয়া হয়েছে তাদের একজন হলেন অশোক দ্যা গ্রেট আরেকজন আকবর দ্যা গ্রেট মজার ব্যাপার হল হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে একজন হিন্দু রাজাও এই উপাধি লাভ করেননি। অশোক প্রথম জীবনে বৈদিক ধর্মের অনুসারী হলেও পরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। রাজা হওয়ার পরই অশোক সাম্রাজ্য বিস্তারে মনযোগী হন। তিনি পূর্বে বর্তমান আসাম বাংলাদেশ, পশ্চিমে ইরান আফগানিস্হান, উত্তরে পামীর গ্রন্থি থেকে প্রায় সমগ্র দক্ষিণভারত নিজের সাম্রাজ্যভূক্ত করেন। এরপর অশোক কলিঙ্গ প্রজাতন্ত্র দখলে উদ্যোগী হন। খ্রীষ্টপূর্ব ২৬১ (মতান্তরে খ্রীষ্টপূর্ব ২৬৩) দয়া নদীর ধারে ধৌলি পাহাড়ের কাছে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। দু'দলের মধ্যে প্রচুর হতাহতের মধ্যে অশোক কলিঙ্গজয় করেন। এই যুদ্ধে কলিঙ্গবাহিনীর ,০০,০০০ সেনা মৌর্য সেনাবাহিনীর ১০,০০০ সেনা নিহত হয় অসংখ্য নর-নারী আহত হয়। যুদ্ধের এই বীভত্সতা সম্রাট অশোককে বিষাদগ্রস্থ করে তোলে। তিনি যুদ্ধের পথত্যাগ করে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনের নীতি গ্রহণ করেন।

৬০৬ খ্রীষ্টাব্দ (-১৪০৬ বছর) গৌড় রাজ্যঃ বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা ছিলেন শশাঙ্ক যিনি ৬০৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলে। সম্ভবত তিনি গুপ্ত সম্রাটদের অধীনে একজন সামন্তরাজা ছিলেল তিনি সম্ভবত হর্ষবর্ধন-এর ভগিনী রাজ্যশ্রী কে অপহরন করে ছিলেন। এইজন্য হর্ষবর্ধন-এর সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয় তাঁর শক্তি বৃদ্ধি হতে দেখে কামরুপ রাজ ভাষ্করবর্মন তাঁর শত্রু হর্ষবর্ধন-এর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন।
৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দে শশাঙ্ক-এর মৃত্যুর পর তাঁর রাজ্যের পতন ঘটে বাংলাতে এক অরাজক অবস্থার সৃস্টি হয় যাকে বাংলায় মাৎস্যন্যায় বলা হয় যা প্রায় দেড়শো বছর তা স্থায়ী হয় এই সময় বাংলাতে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সৃস্টি হয় আত্মকলহ, গৃহযুদ্ধ, গুপ্তহ্ত্যা, অত্যাচার প্রভৃতি চরমে ওঠে।বাংলার সাধারণ দরিদ্র মানুষদের দুর্দশার শেষ ছিল না। স্থায়ী প্রশাসন না থাকাতে বাহুবলই ছিল শেষ কথা।

৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দ (-১২৩৭ বছর) পাল বংশঃ মাৎস্যন্যায়ের সময় বাংলার বিশৃঙ্খলা দমনের জন্য বাংলার মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে গোপাল নামক এক সামন্তরাজা কে বাংলার রাজা হিসেবে গ্রহন করেন গোপালই হলেন পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা পাল বংশের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই রাজা ছিলেন ধর্মপাল (রাজত্বকাল ৭৭৫-৮১০ খ্রীষ্টাব্দ) এবং দেবপাল (রাজত্বকাল ৮১০-৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ) পাল শাসকদের রাজধানী ছিলরামাবতী নগরীকোথায়। সেন নৃপতি বিজয় সেনের রাজধানী ছিলবিজয়নগর 
৯৮২ খ্রিস্টাব্দে (-১০৩০ বছর): অতীশ দীপঙ্কর বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মুগ্রহণ করেন, এটি বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তিনি একজন প্রখ্যাত নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করলে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। একত্রিশ বছর বয়সে ধ্যান শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মগধের জ্ঞানবৃদ্ধ আচার্য ধর্মরক্ষিতের কাছে যান। এর পর ১০১১ সালে তিনি ১২৫জন অনুগামী ভিক্ষুসহ এক সওদাগরী জাহাজে মালয়দেশের সুবর্ণদ্বীপে যান এবং সেখানে প্রখ্যাত আচার্য ধর্মকীর্তির কাছে ১২ বছর বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। পরে কিছু দিন শ্রীলংকায় অবস্থান করে ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে ৪৪ বছর বয়সে তিনি আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। সময় বজ্রাসন মহাবোধি বিহারে (বর্তমান বৌদ্ধগয়া) আয়োজিত সংবর্ধনায় তার অসামান্য পান্ডিত্যের জন্য 'ধর্মপাল' উপাধি দেওয়া হয়। তিব্বতের রাজা চ্যান-চাব জ্ঞানপ্রভ তাঁকে আমন্ত্রণ করলে তিনি ১০৪১ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে যাত্রা শুরু করে দুর্গম হিমালয় পর্বতমালা পাড়ি দিয়ে তিব্বতে যান। তিব্বতে পৌঁছে দীপঙ্কর রাজকীয় মর্যাদা লাভ করেন। এখনও সেখানকার মঠের প্রাচীরে এই সংবর্ধনার দৃশ্য আঁকা আছে। তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসা কারিগরিবিদ্যা সম্পর্কে তিব্বতি ভাষায় দুইশ'রও বেশি বই রচনা, অনুবাদ সম্পাদনা করে তিব্বতবাসীদের মাঝে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তিব্বতবাসীরা গৌতম বুদ্ধের পরেই তাঁকে স্থান দেয় এবং তাঁকে 'জোবো ছেনপো' বা মহাপ্রভুরূপে মান্য করে। তারা তাঁকে "অতীশ" উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি তিব্বতে বহু প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথি আবিষ্কার করেন এবং নিজ হাতে সেগুলির প্রতিলিপি করে বাংলায় পাঠান।

১২০৪ এডি(-৮০৮ বছর) ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খালজি বাংলা জয় করেন। বাংলায় মুসলিম শাষনের সুচনা হয়। ১২৬৮ থেকে ১২৮১ পর্যন্ত ঝিনাইদহ মুসলিম রাজ্য তথা দিল্লী সালতানাতের অধীনে লক্ষনাবতীর অন্তর্ভূক্ত হয়। ইখতিয়ার উদ্দিন বাংলা জয় করে রংপুর অঞ্চলে তাঁর প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন।
১৩৪২ সালে সুলতান শাসুদ্দিন ইলয়াস শাহ্ লক্ষনাবতীকে স্বাধীন সালতানাত ঘোষণা করে বাংলাকে একটি প্রশাসনিক কাঠামোতে আনেন।

১৫৩৪ এডি(-৪৭৮ বছর) পর্তুগিজদের আগমন ব্যবসার অনুমতি লাভ।

১৫৩৮ এডি(-৪৭৪ বছর) গিয়াসউদ্দিন শাহ তার পর্তুগিজ মিত্ররা শের শাহ এর কাছে পরাজিত হন। মঘল সম্রাট হুমায়ুন গৌর দখল করেন, কিন্তু বাংলার সুলতান শের শাহ এর কাছে পরাজিত বিদ্ধ্স্ত হন।

১৫৭৮ এডি(-৪৩৪ বছর) মুঘল সুবেদার খান জাহান বাংলা আক্রমন করে ঈশা খার কাছে পরাজিত হন।

১৫৮৪ এডি(-৪৭৪ বছর) মুঘল সুবেদার শাহাবাজ খান বাংলা আক্রমন করে ঈশা খার কাছে পরাজিত হন।

১৫৯৭ এডি(-৪৬১ বছর) মুঘল সেনাপতি মান সিং ঈশা খার কাছে পরাজিত হন।

১৬০৮ এডি(-৪৫০ বছর) মুঘল সুবেদার ইসলাম খান বাংলা জয় করেন, ঢাকাকে এই অঞ্চলের রাজধানী করেন। মুঘল শাষক জাহাঙ্গিরের নামানুষারে ঢাকার নাম জাহাঙ্গির নগর করেন।

১৭৫৭ এডি(-২৫৫ বছর) বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশী নামক স্থানে ১৭৫৭ সালের জুন ২৩ তারিখে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়।

১৭৭০ এডি(-২৪২ বছর) ৭৬-এর মন্বন্তর(বাংলা ১১৭৬- ১১৮০) দের কোটি বাঙ্গালী মারা যায়। ইংরেজ শাসনের আগের জমানায় যখনই কোথাও দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা দেখা দিত স্থানীয় রাজারা জমিদাররা প্রজাদের রাজস্ব ছাড় দিতেন এবং সেচ ব্যবস্থা সহ নানা প্রকার ত্রানের সাহায্যে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিতে চেষ্টা করতেন কিন্তু ১৭৭০ সাল থেকেই দরিদ্র প্রজাদের অনাহারে মৃত্যুর হার ক্রমশ বাড়তে থাকা সত্ত্বেও ইংরেজ কলোনিয়াল প্রভুরা দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত সকল প্রকার আগাম পূর্বাভাষ কে উপেক্ষা করলেন এর অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ ১৭৭১ সালে কৃষকদের মৃত্যু মহামারীর রূপ নিলো আর ঠিক সেই বছরেই বিপুল পরিমাণ কৃষক-মৃত্যুর ফলে নিজেদের ব্যবসায়িক ক্ষতিকে পূরণ করার জন্য কোম্পানি জমির রাজস্ব বাড়িয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ করে তুলেছিল আর এর ফল স্বরূপ যে কতিপয় সংখ্যক কৃষক দুর্ভিক্ষ মৃত্যুর হাত থেকে কোনও ক্রমে পার পেয়েছিল, ভাগ্যের করুণ পরিহাসে ব্রিটিশ রাজকোষকে এই বিপুল ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাবার দায়িত্বও সেই তাঁদের নড়বড়ে কাঁধের উপরেই গিয়ে পড়লো এবং তাঁদের রাজস্বের হার বেড়ে হয়ে হল দ্বিগুণ
১৮৫৭ এডি(-১৫৫ বছর) সিপাহি বিপ্লব। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির শাসনের অবসান ঘটায় এবং বাংলা সরাসরি ভাবে ব্রিটিশ রাজবংশের শাসনাধীনে আসে বাংলা ছিল খুব ভালো ধান ৎপাদক অঞ্চল এবং এখানে সূক্ষ সুতিবস্ত্র মসলিন তৈরি হত এছাড়া এই অঞ্চল ছিল পৃথিবীর পাট চাহিদার মুখ্য যোগানকারী।

১৮৫০ সাল থেকেই বাংলায় ভারতের প্রধান শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠতে থাকে এই শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছিল মূলত কলকাতার আশেপাশে এবং সদ্য গড়ে ওঠা শহরতলি এলাকায় কিন্তু বাংলার বেশিরভাগ মানুষ তখনও কৃষির উপরেই বেশি নির্ভরশীল ছিলেন ভারতের রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে বাংলার মানুষেরা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করলেও বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় তখনও খুব অনুন্নত জেলা ছিল
১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দে রানী ভিক্টোরিয়া যখন ভারতের সম্রাজ্ঞী উপাধিতে নিজেকে ভূষিত করলেন তখন ব্রিটিশরা কলকাতাকে ব্রিটিশ রাজের রাজধানী বলে ঘোষনা করে

১৯০৫ এডি(-১০৭ বছর) বঙ্গ-ভঙ্গ।

১৯১৩ এডি(-৯৯ বছর) আহমদিয়া/ কাদিয়ানিদের উত্থান।

১৯২১ এডি(-৯১ বছর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।

১৯৪০ এডি(-৭২ বছর) শের--বাংলা কর্তিকমুসলম লীগগঠন।

১৯৪৭ এডি(-৬৫ বছর) ভারত পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ। তখন বাংলা ভাগ করে পশ্চিম বাংলা ভারতের একটি অংশ এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি অংশে পরিণত করা হয়

১৯৪৮ এডি(-৬৪ বছর) খাজা নিজামউদ্দিন(ঢাকা) পাকিস্তানের ২য় গভর্নর- জেনারেল হন।
১৯৪৯ এডি(- ৬৩ বছর)আওয়ামী মুসলিম লীগগঠন।
১৯৫১ এডি(-৬১ বছর) খাজা নিজামউদ্দিন(ঢাকা) পাকিস্তানের ২য় তম প্রধানমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন।

৫২ এডি(-0 বছর) বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক আন্দোলন মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে ৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণ দাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ বপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বে-আইনী নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ( ফাল্গুন ১৩৫৮) আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক[], সালাম, বরকত-সহ[][] আরও অনেকে

১৯৫৩ এডি(-৫৯ বছর) আওয়ামী মুসলিম লীগএর নাম পরিবর্তন করেআওয়ামী লীগকরা হয়।
মোহাম্মদ আলী (বগুরা) পাকিস্তানের ৩য় তম প্রধানমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন।

১৯৫৬ এডি(-৫৬ বছর) ইস্কান্দার মীর্জা(মুর্শিদাবাদ/রাজশাহী)” পাকিস্তানের শেষ গভর্নর জেনারেল ১ম প্রেসিডেন্ট।। একই বছর হসেন শহীদ সহরোয়ার্দী পাকিস্তানের ৫ম তম প্রধানমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন। এই বছরই বাংলা -কে রাষ্ট্রভাষা ঘোষনা করা হয়।

১৯৬৫ এডি(-৪৭ বছর) ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধেঃ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে কাশ্মীরে চরম মার খায় ভারতীয় বাহিনী। বিশ্ব সেরা গুর্খা রেজিমেন্ট প্রথমেই পলায়ন করে। পরে বাংলার দামাল ছেলেরা খালি হাতে বুকে মাইন নিয়ে ট্যাঙ্ক এর নিচে ঝাপিয়ে পড়ে। সেই সময়ের পাকিস্তান আর্মির অধিকাংশ খেতাব, হিলাল জুরাত, সিতারা আম উপাধি এই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পায়।

১৯৬৬ এডি(-৪৬ বছর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দফা আন্দোলন।

১৯৬৮ এডি(-৪৪ বছর) আগরতলা ষরযন্ত্র মামলা।

১৯৬৯ এডি(-৪৩ বছর) ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান

১৯৭০ এডি(-৪২ বছর) ভোলা সাইক্লোন, প্রায় ,০০,০০০ মানুষ মারা যায়।

১৯৭১ এডি(-৪১ বছর) বঙ্গবন্ধুর সাথে গোলটেবিল বৈঠক সফল না হওয়ায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে বাঙালিদের উপর নির্বিচারে আক্রমণ শুরু করে। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
প্রায় কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযুদ্ধে মোট জীবনহানির সংখ্যার কয়েক লাখ হতে শুরু করে ৩০ লাখ পর্যন্ত অনুমান করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে অস্থায়ী সরকার গঠন করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলে দীর্ঘ মাস। মুক্তি বাহিনী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভারতের সহায়তায় প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনির বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে জয়লাভ করে। এই সময় অধিকাংশ বাঙ্গালী সামরিক কর্মকর্তা পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন। মিত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল জগজি সিং অরোরার কাছে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পন করেন।
প্রায় ৯০,০০০ পাকিস্তানী সেনা যুদ্ধবন্দী হিসাবে ধরা পড়ে, যাদেরকে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। স্বাধীনতা পরবর্তীতে মোট ৩৬০০০ স্থানীয় দালাল, রাজাকারকে সরাসরি গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্য ২৬০০০ জনকে বঙ্গবন্ধু সাধারন ক্ষমা করে ছিলেন। বিচারপতি সায়েম সিএমএলএ থাকা অবস্থায় বাকিদের মুক্ত করে দেন।
১৯৭২-১৯৭৫ এডি(-৪০ বছর) স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ প্রথমে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালের শুরুতে মুজিব দেশে বাকশালের অধীনে সকল দল এবং ব্যক্তি নিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর কিয়দংশ ষড়যন্ত্রে সংঘটিত অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন।

১৯৭৫-১৯৮১ এডি(-৩৮ বছর) ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর ‘’সিপাহি বিপ্লব’’ নামের আন্দোলনে জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে সংশ্লিস্ট হন। ১৯শে নভেম্বরের পর তিনি উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েমের পরে ২১শে এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নামের রাজনৈতিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক . কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন। ১৯৮১ সালের ২৯শে মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন।

১৯৮২-১৯৯০ এডি(-৩১ বছর) ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রক্তপাতবিহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। এরশাদ স্বৈরশাসক হিসাবে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে তার পতনের পর সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরায় চালু হয়।

১৯৯১-১৯৯৬ এডি(-২২ বছর) জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেত্রী হিসাবে ১৯৯১ হতে ১৯৯৬ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৬-২০০১ এডি(-১৭ বছর) শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতায় ছিলেন।

২০০১-২০০৬ এডি(-১২ বছর) চারদলীয় ঐক্যজোট, জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেত্রী হিসাবে ২০০১ হতে ২০০৬ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৬-২০০৯ এডি(-০৭ বছর) তত্ত্বাবধায়ক সরকার,

২০০৯- এডি(-০৪ বছর) চৌদ্দদলীয় মহাজোট, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে, এবং দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

২০১২-বর্তমানঃ স্বাধীনতার ৪২ বছর পর দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করা হয়।

২০১৪-বর্তমানঃ ভোটার বিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতা গ্রহন, গনতন্ত্র বিলুপ্ত। আওয়ামী লীগ বিরোধী সবাইকে স্বাধীনতা বিরোধী আক্ষা্য়িত করা আরম্ভ